4:23 pm , July 17, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ করোনা মহামারীর ছোবলে বিপন্ন বরিশাল অঞ্চলের শতবর্ষের পুরনো ভাসমান নৌকার হাটগুলো মন্দা কাটিয়ে এবার প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশাবাদী কারিগর ও ব্যসায়ীরা। এসব নৌকার হাটকে ঘিরে কাঠ ব্যবসায়ী সহ নৌকা নির্মাতা এবং বিক্রেতাদের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে কাঠ, লোহা সহ সব উপকরণের পাশাপাশি নির্মাতাদের মজুরী বৃদ্ধির ফলে নৌকার দামও বেড়ে যাওয়ায় আশানুরুপ বিক্রী নিয়ে গত বছরের মত এবারো সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। করোনার প্রথম দুটি বছরের তুলনায় গত বছর বর্ষা মৌসুমে ভাসমান নৌকার হাটে কিছুটা প্রাণস্পন্দন ফিরলেও এবার অষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবনের ভরা বর্ষা মৌসুমেও কাঙ্খিত বৃষ্টির অভাবে নৌকা বিক্রী নিয়ে কিছুটা সন্দিহান ভাসমান হাটের ব্যাবসায়ীরা।
বরিশালের বানরীপাড়া ছাড়াও নেছারাবাদ ও ঝালকাঠি সদরের শত বছরের বেশী সময় ধরে বিভিন্ন নদ-নদী ও বড় মাপের খালের মোহনায় ভাসমান নৌকার হাটগুলো এখনো তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে করোনা মহানমারী সংকটে ২০২০ ও ’২১ সালে পুরো হাটে কেনা বেঁচা ছিল প্রায় বন্ধ। গত বছর থেকে পরিস্থিতির ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করলেও এবার নৌকা নির্মাতা ও বিক্রেতারা খুব আশা নিয়ে প্রতিটি ভাসমান হাটে হাজির হলেও এখনো বানিজ্য আশানুরুপ নয় বলে জানিয়েছেন। তবে গত কয়েক দিন ধরে ক্রেতা সমাগম কিছুটা বাড়লেও তা করোনা পূর্বকালীন অবস্থায় ফিরে আসেনি। কিন্তু নির্মাতা ও ব্যবসায়ীরা করোনাকালীন দুটি বছরের নৌকা শিল্পে বিরুপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিগত কয়েকটি বর্ষা মৌসুমের মত এবারো নৌকা তৈরীর কারিগর সংকটে কিছুটা বিপর্যস্ত বরিশাল অঞ্চলের নৌকার মোকামগুলো। সাথে কাঠ, লোহা সহ বিভিন্ন উপকরনের দাম প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধির ফলেও ক্রেতাদের আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে। বিক্রেতাদের দাবী কাঠ সহ সব উপকরন ও মজুরী বৃদ্ধির সাথে নৌকার দাম তুলনামূলক ভাবে না বাড়ায় তারা লাভের মুখ দূরের কথা পূঁজি ঘরে তুলতে পারছেন না। ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িতরা এবার যথেষ্ট বিপাকে। পাশাপাশি এসব ভাসমান ও মৌসুমী হাটে কারিগরের অভাবে নৌকা তৈরি অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। করোনাকালীন দুটি বছর লকডাউনে পারিবহন বন্ধ থাকায় দূর-দূরান্তের ক্রেতারা এসব হাটে আসেনি। একই সাথে অর্থনৈতিক মন্দায়ও বেঁচা কেনায় ছিল ভাটির টান ।
খাল-বিল, নদী-নালা বেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চল জুড়েই বর্ষা মৌসুমে নৌকার কদর অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী। বিশেষ করে বর্র্ষার এসময়ে কৃষকরা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করেই রোপা আমনের বীজ সহ নানা কৃষি উপকরন নিয়ে অর্ধ নিমজ্জিত ফসলের জমিতে যায়। এছাড়াও ভরা বর্ষায় প্লাবিত বরিশালের বানরীপাড়া ও আগৈলঝাড়া, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া, পিরোজপুরের নাজিরপুর ও নেছারাবাদের অনেক এলাকায়ই এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতেও এখনো নৌকাই একমাত্র বাহন। এমনকি নাজিরপুরের অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের বাহন এসব ডিঙ্গি নৌকা। আউশ ধান কাটা ছাড়াও ঝালকাঠী ও নেছারাবাদের পানি বেষ্টিত বাগান থেকে পেয়ারা, আমড়া ও সবজিসহ অন্যান্য ফল ও কৃষি পণ্য সহ ফসল সংগ্রহ এবং বাজারজাত করতেও এখনো নৌকার কোন বিকল্প নেই। বরিশাল সংলগ্ন ঝালকাঠীর ভিমরুলীতে গত প্রায় শত বছর ধরে নৌকার ওপরই পেয়ারার ভাসমান হাট বসছে। এ ছাড়াও বরিশাল,ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বিল বেষ্টিত এলাকায় প্রায় ৩০টি ভাসমান হাট রয়েছে। এসব ভাসমান হাট দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবারো বর্র্ষা মৌসুমে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটছে। বরিশালের বানরীপাড়াতেও সপ্তাহে দুদিন ধান-চালের ভাসমান হাট বসছে। তবে কালের বিবর্তনে তার রমরমা বানিজ্য এখন অনেকটাই অতীত।
এবার ভরা বর্ষা মৌসুমেও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের নদী-নালা এবং খাল-বিলগুলো পানিতে টই-টুম্বুর না থাকলেও শেষ শ্রাবণের পূর্ণিমা ও ভাদ্রের ভরা অমাবস্যার সময় ফুঁসে ওঠা সাগরের জোয়ার আর গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার বর্ষণে বর্ষার প্রকৃত রূপ ফিরে আসবে বলে আশাবাদী নৌকা ব্যবসায়ীরা।
এমনকি শতাধিক বছরের পুরনো আটঘর-কুড়িয়ানা ও ভীমরুলির হাটে এবার আগের দুটি বছরের সংকট কাটিয়ে নৌকার হাটে যথেষ্ট প্রাণ ফিরবে বলে এখনো আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। বরিশালের বানরীপাড়া ও সংলগ্ন নেছারাবাদের নৌকার হাট এখন আগের কয়েকটি বছরের তুলনায় অনেকটাই সজীব।