ডেঙ্গু মহামারিতে বরিশাল ॥ শেবাচিমে নেই প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিন ডেঙ্গু মহামারিতে বরিশাল ॥ শেবাচিমে নেই প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিন - ajkerparibartan.com
ডেঙ্গু মহামারিতে বরিশাল ॥ শেবাচিমে নেই প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিন

4:20 pm , July 15, 2023

মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বহীনতা !
হেলাল উদ্দিন ॥ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলায় মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েছে বরিশালের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা। ২০২২ সালে প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিন ( ডেঙ্গু রোগীদের পরীক্ষার জন্য) চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলো শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপরও বহুবার তাগাদা ও দেনদরবার করা হয়েছে কিন্তু এ বিষয়ে অনঢ় অবস্থানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর। যে কারনে প্রত্যাশিত ও প্রয়োজনীয় ওই যন্ত্রটি শেবাচিম হাসপাতালে বরাদ্দ বা প্রেরণ করেনি দাযিত্বশীলরা। উৎকন্ঠার বিষয় হচ্ছে ডেঙ্গুর চলমান এই মহামারির সময়েও যন্ত্রটি পাচ্ছে না শেবাচিম হাসপাতাল। কারন অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত এই মেশিন ক্রয়ের জন্য দরপত্রই আহবান করেনি। শেবাচিম হাসপাতাল পরিচালক ডাঃ এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, মেশিনটি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আমরা বার বার অনুরোধ করেছি কিন্তু দেয়নি। সর্বশেষ গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডাঃ মাজাহারুল ইসলাম তপন স্যারের সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন চেষ্টা চলছে। এখনো টেন্ডার করা হয়নি। তবে টেন্ডার হলে আমাদের হাসপাতালে একটি মেশিন দিবেন বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
প্রতিদিনই দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশাল বিভাগের হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থায় নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। তবে এরইমধ্যে বরিশালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং একজনের মৃত্যু অনেকটাই ভাবিয়ে তুলেছে। তাই বর্তমানে প্লাটিলেট আলাদা করার কোনো ব্যবস্থা গোটা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে না থাকায় রোগীর অবস্থা সংকটের দিকে গেলেই ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ২০ হাজারের নিচে রক্তের প্লাটিলেট  নেমে গেলেই সেই রোগীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
বিগত যে কোন সময়ের চেয়ে বরিশালে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। শনিবার ২৪ ঘন্টায় বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১২৩ জন। এদের মধ্যে শুধু শেবাচিম হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছেন ২৮ জন। বিভাগের সকল সরকারী হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত  ৩৫৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। হাসপাতাল পরিচালক বলেন এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। ৪ টি ওয়ার্ডে ৫০ টি করে মোট ২০০ বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য। সে হিসাবে এখনো বেড সংকট তৈরী হয়নি। জনবলও যথেষ্ট রয়েছে। সংকট বলছে শুধু প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিনটির। এটি হলে ডেঙ্গু আক্রান্ত কোন রোগীকে ঢাকা প্রেরন করতে হবে না।
তথ্য বলছে এবার সকল বয়সের মানুষ ডেঙ্গুতে অক্রান্ত হচ্ছে। তবে শিশুদের সংখ্যা কিছুটা বেশী। আর আতংক আর ভীতিটা এখানেই বেশী। কারন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে থাকা। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে থাকাদের সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হয়। কখনো কখনো শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। এছাড়া কারও কারও ত্বক শীতল হয়ে আসে, ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপরে লাল ছোপ সৃষ্টি হয়। এছাড়া আরও নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের উপসর্গ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া। ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপর লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচ- পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। শিশু-বৃদ্ধদের মধ্যে যারা দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা কিডনি রোগে আক্রান্ত, ডায়াবেটিস, হার্ট, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। আরো বিপজ্জনক তথ্য হলো এবার কোভিড ও ডেঙ্গুতে একসঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
বরিশাল  বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। তবে এবার আগেভাগেই হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। তাই জ্বর হলে প্রথমেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। ঢাকা থেকে আসা বাস, লঞ্চসহ যানবাহনে এডিস মশার বিস্তৃতি ঘটতে পারে জানিয়ে ডা. শ্যামল কৃষ্ণ বলেন, ২০১৯ সালে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় বরিশালে। তারপর থেকে প্রতিবছরই ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে। এবারেও ঈদুল আজহার পর ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তৃতি দেখা দিয়েছে। আর এসব রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা থেকে আসার পরে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বলেও তারা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতা প্রয়োজন। বিশেষ করে এডিস মশার বিস্তার রোধ, লার্ভা ধ্বংস করতে হলে সবাইকে সচেতন হতেই হবে। যেমন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে যেন নতুন কোনো মশায় না কামড় দেয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে যে মশা কামড়ে দেয়, সেটিও এডিসবাহী হয়ে বংশবিস্তার ঘটাতে পারে। এজন্য ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখতে বলা হয়। এছাড়া জমে থাকা পানি অপসারণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজন, যা নিশ্চিত হলে মশার বংশবিস্তার রোধ হবে এবং আমরাও সুস্থ থাকবো। প্রসঙ্গত, বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বরিশালে বিভাগের ছয় জেলায় এ পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ৫৯৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ১ হাজার ২৩৬ জন সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের মতে প্লাটিলেট কমে গেলেই যে রক্ত নিতে হবে এমনটা নয়। কেননা ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্লাটিলেট কমে যাওয়াই একমাত্র সমস্যা নয় বরং শরীরের রক্তরস কমে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়াও পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে। বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দেয়ার কোন প্রয়োজন হয় না। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায় খুব কম সময়ের জন্য (হয়তো দুই তিন দিন)। এরপর নিজে থেকেই প্লাটিলেট বাড়তে থাকে।
কখন রক্ত নিতে হয়?
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মূলত রোগীর রক্তনালীগুলোর দেয়ালে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, সেগুলো বড় হয়ে যায়। এতে রক্তনালীর দেয়াল ভেদ করে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস নালির বাইরে বের হয়ে আসে। একে প্লাজমা লিকিংও বলা হয়। এতে রোগীর পেটেবুকে পানি জমতে পারে। সেইসাথে রোগীর রক্তচাপ কমতে থাকে। প্লাটিলেট কমার চাইতে, রক্তচাপ কমে যাওয়া ডেঙ্গু রোগীর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্লাটিলেট কমে যাওয়াসহ এমন আরও কয়েকটি কারণে রোগীর মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃদপি-ের রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে।
যেসব খাবারে প্লাটিলেট বাড়েঃ
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে সুষম খাবারের পাশাপাশি তরল জাতীয় খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে কিছু খাবার রয়েছে যা খেলে রক্তে কমে যাওয়া প্লাটিলেট আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এমন পাঁচটি খাবার হল: মিষ্টি কুমড়া,লেবুর রস,আমলকী,অ্যালোভেরা,ডালিম। মালয়েশিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পেঁপে পাতার রস এবং পাকা পেঁপের জুস ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তে কমে যাওয়ার প্লাটিলেটের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন সি যুক্ত ফল বা তাজা ফলের রস, সেইসাথে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, প্রোটিন, ভিটামিন কে, ই সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে প্যাকেটজাত খাবার এবং অতিরিক্ত মসলাদার খাবার এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT