4:14 pm , July 9, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল কৃষি অঞ্চলে এবার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে গোল আলু এবং পেঁয়াজের আবাদ ও উৎপাদন হলেও কৃষকের পরিবর্তে মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছেঅ। কয়েকগুন বেশী দামে এ দুটি কৃষিপণ্য কিনতে গিয়ে সর্বশান্ত ভোক্তারা। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি বড় অংশই উৎপাদন হচ্ছে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে। এমনকি দেশে পেঁয়াজ বীজের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশী যোগানদার এ অঞ্চলের কৃষিযোদ্ধারা। গত রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রায় ১১ লাখ ৩৩ হাজার টন পেঁয়াজ ও ২ লাখ ৮০ হাজার টন গোল আলু উৎপাদন হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র পরিসংখ্যান বলছে। কিন্তু বেশীরভাগ কৃষকই এ দুটি কৃষিপণ্য মাঠ থেকে ফরিয়াদের কাছে নির্দিষ্ট দামে বিক্রী করতে বাধ্য হন কৃষি ঋণ এবং ধার-দেনা শোধ সহ নগদ অর্থের প্রয়োজনে। মূল মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের মাঠে মাঠে প্রতি কেজি গোল আলু মাত্র ৮-১০ টাকা এবং পেঁয়াজ ১০-১২ টাকা কেজি দরে বিক্রী করতে বাধ্য হন কৃষকরা। কিন্তু ফরিয়াদের মাধ্যমে এসব কৃষিপণ্য মহাজনের হাত ধরে হীমঘরে ঢোকার পরে প্রথমে তা দ্বিগুন দামে বাজারে আসার পরে এখন সব সীমা ছাড়িয়েছে।
বীজ ও সারসহ অন্যান্য উপকরন এবং কৃষি শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির কারণে এবার প্রতিমন পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ৬শ টাকা। অথচ মাঠ পর্যায়ে সাড়ে ৪শ টাকার বেশী দরে তা কিনতে অনীহা প্রকাশ করতো ফরিয়ারা। ফলে লাভের আশা দূরাশায় পরিনত হয়ে বিগত রবি মৌসুমে পেঁয়াজ কৃষকের গলার কাঁটায় পরিনত হয়। কিন্তু তিন মাসের মাথায়ই কৃষকের ১০-১২ টাকায় বিক্রী করা পেঁয়াজ ১শ টাকায়ও কিনতে হয়েছে ভোক্তাদের। অথচ বজারে সরবরাহ ঘাটতি বা চাহিদা অনুযায়ী কোন মজুত স্বল্পতা ছিল না, এখনো নেই। এমনকি আমদানী উম্মুক্ত করার পরেও বরিশাল সহ সন্নিহিত জেলাগুলোতে দেশী পেঁয়াজ এখনো ৬০-৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রী হচ্ছে। অথচ গত বছর এ সময়ে দেশী পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজিতেই কিনতে পেরেছিলেন ভোক্তারা। এমনকি বিগত রবি মৌসুমে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের মাধ্যমেই চাহিদার সিংহভাগ মেটানো সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে পেঁয়াজের আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে ৫০ ভাগেরও বেশী। কিন্তু এবার উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় আগামী বছরগুলোতে কৃষকের মাঝে এ অর্থকরী ফসল আবাদের আগ্রহ কতটা অক্ষুন্ন থাকবে তা নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদও ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে রবি ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদের ক্ষেত্রে এখনো উন্নতমানের ও উচ্চ ফলনশীল বীজ সহ আবাদ প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে পৌঁছেনি। এমনকি ‘বারি’ ইতোমধ্যে উচ্চ ফলনশীল পেঁয়াজ-এর একাধিক জাত উদ্ভাবন করলেও কৃষক পর্যায়ে তার বীজ এবং আবাদ প্রযুক্তি হস্তান্তর না হওয়ায় এতদিন ঘাটতি মোকাবেলাও সম্ভব হয়নি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেঁয়াজের আবাদ ও উৎপাদন বাড়লেও এখন উৎপাদিত পেঁয়াজ ক্রমশ কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে উঠতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন কৃষিবীদরা। কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত “বারিÑ১” নামের বীজ থেকে হেক্টর প্রতি ১২Ñ১৬ টন পর্যন্ত উন্নতমানের পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব।
অপরদিকে বিগত রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টন গোল আলু উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। কিন্তু বরিশাল ও সন্নিহিত এলাকায় চাষিরা মাঠ পর্যায়ে প্রতি কেজি গোল আলু সর্বোচ্চ ১০ টাকার বেশী দরে বিক্রী করতে পারেননি। অথচ সার, বীজ সহ কৃষি শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির কারণে সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে প্রতি কেজি গোল আলুর উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ১০ টাকা। ফলে পেঁয়াজের মত গোল আলুতেও বরিশাল কৃষি অঞ্চলের কৃষকরা উৎপাদন করে মুনাফা দূরের কথা অনেকে লোকসান গুনতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু ফরিয়ারা মাঠ পর্যায়ের সব গোল আলু মহাজনের ঘরে তুলে সেখান থেকে হীম ঘরে মজুতের পরে এখন বাজারে সেই কৃষিপণ্য ৪০ টাকা কেজি। যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর সর্বোচ্চ।
‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিউট-বারি’ উদ্ভাবিত উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল আলু বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর পাশাপাশি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করলে দক্ষিণাঞ্চলেই গোল আলুর আবাদ ও উৎপাদন অন্তত দেড়গুন বৃদ্ধি সম্ভব বলেও মনে করছেন কৃষিবীদরা। ‘বারি’ ইতোমধ্যে ‘বারি আলুÑ১ (হিরা), বারি আলুÑ৪ (আইলসা), বারি আলুÑ৭ (ডায়মন্ট), বারি আলুÑ৮ (কার্ডিনাল), বারি আলুÑ১১ (চমক), বারি আলুÑ১২ (ধীরা), বারি আলুÑ১৩ (গ্রানোলা), বারি আলুÑ১৫ (বিনেলা), বারি টিপিএসÑ১ ও বারি টিপিএস-২’ নামের একাধিক উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল আলুবীজ উদ্ভাবন করেছে।