4:09 pm , July 3, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে জাটকা আহরণ, বিপনন ও পরিবহনে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল ১ জুলাই রাতের প্রথম প্রহর থেকে। গত ১ নভেম্বর থেকে ৮ মাসের এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘœ করতে আশি^নের পূর্ণিমার আগে পরে গত ৬ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৮ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে প্রধান প্রজননস্থলে সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। একই সময়ে সারাদেশে ইলিশ আহরণ,পরিবহন ও বিপনন বন্ধ ছিল। গত ১ নভেম্বর থেকে ইলিশ পোনা-জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সাগরে চলমান ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় এলাকায় ইলিশসহ সব ধরনের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরণ ছিল ৫.৬৭ লাখ টন। যার প্রায় ৭০ ভাগের অহরণ ছিল বরিশাল অঞ্চলে। সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে ইলিশের উৎপাদন আরো বৃদ্ধির আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস্য গবেষনা ইনসস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহহিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন, ইলিশের নির্বিঘœ প্রজনন নিশ্চিত করতে গত বছর অক্টোবরে ২২দিনের আহরণ, পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞাকালে উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। ফলে সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ টনের কাছে পৌঁছতে পারে বলেও আশাবাদী মৎস্য বিজ্ঞানীরা।
জাটকা আহরণে নির্ভরশীল জেলেদের গত ৮ মাসের আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে উপকূলীয় ২০টি জেলার ৯৭ উপজেলার ৩ লাখ ৬১ হাজার জেলে পরিবারের জন্য ৫৭ হাজার ৭৩৯ টন চাল বরাদ্দ ও বিতরণ করেছে সরকার। চার মাসে ৪০ কেজি করে এসব চাল বিতরণ করা হয়। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার ২ লাখ ৩০ হাজার ১৮৭ জেলে পরিবারকে ৩৬ হাজার ৮২৯ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
জাটকা আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় এবারো জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমান আদালত এবং মৎস্য বিভাগের অভিযানে নৌ বাহিনী, কোষ্টগার্ড, পুলিশ ও র্যাব সহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহযোগীতায় ব্যাপক সাফল্য এসেছে। গত ৮ মাসে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি অভয়াশ্রম সহ অভ্যন্তীরণ ও উপকূলীয় নদ-নদীতে সাড়ে ১১ হাজারের বেশী অভিযান সহ প্রায় ২ হাজার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আইন অমান্য করায় এ সময়ে সাড়ে ১৩শ মামলা দায়ের ছাড়াও ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং ৫৮৪ জন জেলে ও মৎস্যজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
এসব অভিযানের ফলে দেশে বিপুল পরিমান জাটকা অবৈধ নিধন থেকে রক্ষা পাওয়ায় ইলিশ সম্পদ আরো সমৃদ্ধ হবার আশা করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে সক্ষম। উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে থাকে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
আহরণ নিয়ন্ত্রনসহ নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯,২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। যা পরবর্তী বছরগুলোতেও আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদনও গত দুই দশকে প্রায় ৩গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাবিশ্বে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৬৫Ñ৭০% এখন বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১% এরও বেশী, আর মৎস্য খাতে প্রায় ১২%।