ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বিস্ফোরনে উড়ে গেছে ট্যাংকারের মাষ্টার ব্রীজ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বিস্ফোরনে উড়ে গেছে ট্যাংকারের মাষ্টার ব্রীজ - ajkerparibartan.com
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বিস্ফোরনে উড়ে গেছে ট্যাংকারের মাষ্টার ব্রীজ

4:07 pm , July 2, 2023

একজনের লাশ উদ্ধার ॥ নিখোঁজ-৩ ॥ দগ্ধ-৪

*উদ্ধার অভিযান না করে তেল অপসারণে ব্যস্ত থাকার অভিযোগ
*ঘটনায় ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
রিয়াজুল ইসলাম বাচ্চু, ঝালকাঠি ॥ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে জ্বালানী তেল খালাসের জন্য ইঞ্জিন চালু দিয়ে ট্যাংকার সাগর নন্দিনী-২ বিষ্ফোরিত হয়েছে। এতে দগ্ধ হয়েছেন ট্যাংকারে থাকা ৪ জন কর্মচারী। এর মধ্যে রোববার দুপুরে ইঞ্জিন রুম থেকে এক জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনো নিখোজ রয়েছেন ৪ জন। অক্ষত অবস্থায় ট্যাংকারের বাবুর্চি ঝালকাঠি সদর থানায় পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। ওই বাবুর্চি জানান, জাহাজে সর্বমোট ১৩ জন কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে হতে ২ জন ছুটিতে আছেন। বাকীরা জাহাজের মধ্যে ছিলেন।খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঝালকাঠি, রাজাপুর, নলছিটি ও বরিশালের ৫টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রন করেছে। শনিবার বেলা ১ টা ৩০ মিনিটের দিকে ঝালকাঠি পৌরসভা খেয়াঘাটের বিপরীত পাশে সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাজাপুর গ্রামের কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠি সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নাসির উদ্দিন সরকার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সাগর নন্দিনী-২ নামের জাহাজটি ঝালকাঠি শহরের সুগন্ধা নদীর পাড়ে তেল খালাস করতে পেট্রোল ও ডিজেল নিয়ে আসে। জাহাজটি নোঙ্গর করা অবস্থায় হঠাৎ বিকট শব্দে বিষ্ফোরণ হয়। পরে জাহাজের ইঞ্জিনরুমে আগুন ধরে কালো ধুয়া বের হতে থাকে। বিষ্ফোরণে ইঞ্জিনরুমের উপরে দ্বিতল বিশিস্ট সুকানি ও স্টাফ কেবিন উড়ে নদীতে পড়ে ডুবে যায়।
বিস্ফোরণের ঘটনায় নদীতে পড়ে থাকা ভগ্নাংশ উদ্ধারে বিআইডব্লিটিএর জাহাজ হামজাকে ঘটনাস্থলে পৌছেছে। এই ঘটনায় পদ্মা কোম্পানী ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান জানান, কোম্পানীর অপারেশন ম্যানেজারকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার থেকে তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে তারা তদন্ত রিপোর্ট দিবে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এক জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে নিখোঁজদের স্বজনরা সাগর নন্দিনী মালিক পক্ষ এবং পদ্মা কোম্পানীর বিরুদ্ধে উদ্ধার অভিযান বন্ধ রেখে তেল সরিয়ে নেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকার অভিযোগ করেছে। নদীর ভিতরে বিস্ফোরণে বিচ্ছিন্ন জাহাজের পিছন অংশের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কোস্টগার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে পানির ভিতরে সন্ধান পাওয়া জাহাজের ঐ অংশের ভিতরে প্রবেশ করা যাচ্ছেনা। তাই উদ্ধার অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। স্বজনদের ধারনা বিস্ফোরণের সময় যারা বেড়িয়ে যেতে পারেনি তাদের মৃতদেহ ঐ অংশের নিচে চাপা পড়ে আছে।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে আগুনে বিস্ফোরনের ঘটনায় নিখোঁজদের স্বজনরা ঘটনাস্থলে এসে কোন সন্ধান না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ, জাহাজ কর্তৃপক্ষের উদ্ধার অভিযানে কোন তৎপরতা নেই। নিখোঁজদের উদ্ধার অভিযানের চেষ্টা করা হচ্ছে না। বরং কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে রক্ষায় জাহাজের তেল সরিয়ে নিতে ব্যস্ত আছে।
নিখোঁজরা হলেন-চাঁদপুর জেলার সুপার ভাইজার মাসুদুর রহমান বেলাল, বাখেরগঞ্জের নলুয়া ইউনিয়নের মাস্টার রুহুল আমিন খান (৪৫), পিরোজপুরের বুড়ির চর গ্রামের ড্রাইভার আকরাম হোসেন সরোয়ার (৪৫), বাকেরগঞ্জের পার্দীশিবপুর গ্রামের রিফাত হোসেন (১৯)।
আহতরা হলেন- পাবনা জেলা মোদাচ্ছেরের ছেলে শাকিল (৩৫), চাঁদপুরের মৃত আবুল হোসেন পাটোয়ারীর ছেলে ফরিদুল আলম (৩৫), পিরোজপুর মঠবাড়িয়ার ছালাম বেপারীর ছেলে ইকবাল হোসেন (২৭), এই জাহাজে মোট ১৩ জন স্টাফের মধ্যে ৩ জন আগেই ছুটিতে ছিলেন। অপর ১০ জনের মধ্যে ৪ জন নিখোঁজ, ৪ জন দগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত এবং ১ জন বাবুর্চী বেলায়েত হোসেন পুলিশের তত্বাবধানে চিকিৎসায় আছে বলে জানাযায়।
ঘটনা স্থলে স্বজনদের ক্ষোভ ও দাবী ঃ রবিবার সকাল ১০ টায় ঘটনাস্থলে থাকা সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে গিয়ে দেখা যায় নিখোঁজদের না পেয়ে স্বজনরা আহাজারী এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তখন পদ্মা অয়েল কোম্পানীর খুলনার এমডি মাসুদুর রহমান, সাগর নন্দিনী-২ জাহাজ কোম্পানীর নির্বাহী পরিচালক মাহাতাবুর রহমান তেল উদ্ধারকারী জাহাজ সেভেন সিমাক-২ এর একটি এসি রুমে বসে আরাম আয়েশ ও নাস্তা করতে ব্যস্ত। এ সময় ওই রুমের সামনে থাকা নিখোঁজদের স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নিখোঁজ মাস্টার রুহুল আমিনের ভাই আব্দুর রহমান, নিখোঁজ সুপার ভাইজার মাসুদুর রহমানের ভাই আলাউদ্দিন, নিখোঁজ ট্যাংকারের চালক আকরাম হোসেনের ভাই মাসুম বিল্লাহ্, নিখোঁজ গ্রীজার ম্যান আব্দুস সালামের মামা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ঘটনার পর খবর পেয়ে এখানে এসে দুইদিন অপেক্ষা করছি। কিন্তু জাহাজ মালিকের কোন প্রতিনিধির এখানে এসে নিখোঁজদের উদ্ধারে কোন তৎপরতা বা চেস্টা আমাদের চোখেঁ পড়েনি। ডিপো কর্তৃপক্ষ মালিক পক্ষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের দূর্ঘটনা কবলিত জাহাজ থেকে তেল সরিয়ে নিতে ব্যস্ত রয়েছে। এখন তারা এসে এসি রুমের মধ্যে আরাম আয়েশ করছে। দ্রুত ডুবুরির মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে আমরা আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানাচ্ছি। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, জাহাজ কর্তৃপক্ষের আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে হবে। গত শনিবার থেকে আমরা এখানে না খেয়ে বসে আছি। এখন পর্যন্ত কোন উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়নি। উদ্ধার কাজ বন্ধ দাবী করে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রবিবার ২ জন ডুবুরী এনে ৫ মিনিটের জন্য পানিতে নামিয়ে আবার তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ মালিক কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘটনার পর নিখোঁজ স্টাফরা দূর্ঘটনার কথা আমাদের না জানিয়ে তারা পালিয়ে গেছে। এটা সম্পূর্ন অসত্য দাবী করে স্বজনরা বলেন নিখোঁজদের জীবিত অথবা মৃত ফিরিয়ে দিতে হবে।
দূর্ঘটনা কবলিত জাহাজের তেল অপসারনের প্রক্রিয়া ঃ এদিকে পদ্মা ডিপো কর্তৃপক্ষ জাহাজ মৃদুলা-৫ এবং সেভেন সিমাক-২ এর মাধ্যমে বিস্ফোরিত জাহাজটির তেল সরিয়ে নিচ্ছে। জানাযায়, সাগর নন্দিনী জাহাজের পুরো তেল এই জাহাজ দুটির মাধ্যমে অপসারন করে পদ্মার ডিপোতে স্থানান্তর করা হবে। সুত্র জানায়, রবিবার সন্ধার মধ্যে জাহাজ থেকে অপর দুইটি জাহাজে ডিজেল স্থানান্তরের কাজ শেষ হবে। এরপর সাগর নন্দিনী কোম্পানীর আরো একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে এসে পেট্রোল স্থানান্তর করে ডিপোতে সরিয়ে নেয়া হবে। এর মধ্যে ৬ লাখ ৭৬ হাজার লিটার ডিজেল অপর জাহাজে স্থানান্তরের কাজ শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও বাকি ৪ লাখ ৫ হাজার লিটার পেট্রোল সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের ভোলা দক্ষিন জোনের লে. শাফায়াত জানান, জাহাজটির এই দূর্ঘটনা স্থলে জেলা প্রশাসন, আমরা, ফায়ার সার্ভিস ইউনিট সমন্বয় করে কাজ করছি। ইতি মধ্যেই পিছনে বিস্ফোরনে জাহাজের নদীর ভিতরে সন্ধান পাওয়া গেছে। ঐ অংশের নিচে কোন মৃতদেহ আছে কিনা তা দেখা সম্ভব হয়নি। নদীতে অতিরিক্ত ¯্রােতের কারনে আমাদের ডুবুরীদল তার ভিতরে প্রবেশ করতে না পারায় চেস্টা অব্যাহত আছে।
ঝালকাঠি ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, আমাদের ডুবুরী দল নদীর পানিতে জাহাজের ভাঙ্গা অংশের ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই এর নিচে কোন মৃতদেহ আছে কিনা তা জানা যায়নি। রবিবার ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে জাহাজের ইঞ্জিন রুমের ভিতর থেকে গ্রীজার ম্যান আব্দুস সালাম হৃদয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
পদ্মা অয়েল কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পারিচালক মো. মাসুদুর রহমান জানান, এই ঘটনায় ৪ সদস্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার দাবী বিস্ফোরীত জাহাজের মালিক পক্ষ ঘটনার পর থেকেই সার্বিক সহযোগীতা করছে। উদ্ধার কাজ অব্যাহত আছে। প্রাথমিক ভাবে তিনি এই দূর্ঘটার কারন সম্পর্কে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট ছাড়া বলা যাবেনা। ইতিপূর্বে একই স্থানে সাগর নন্দিনী-৩ এ অনুরুপ দূর্ঘটার তদন্ত রিপোর্টে কি কারন পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তিনি এবষিয়ে কিছু বলবেন না বলে জানান।
ঝালকাঠি পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, সর্বশেষ জাহাজের ইঞ্জিন রুম থেকে যে মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাকে সনাক্ত করেছে জাহাজের বাবুর্চি বেলায়েত হোসেন। দূর্ঘটনার পর আহত বাবুর্চি বেলায়েতকে পুলিশের সহায়তায় চিকিৎসা করে তাকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মৃতদেহ সনাক্তের জন্য রাখা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতদের স্বজনরা কোন অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
উল্লেখ্য, ৬ মাস আগে সাগর নন্দিনী-২ নামের এই জাহাজটি ভোলায় নদীতে নিমজ্জিত হয়। এরপর জাহাজটি উদ্ধার করে সংস্কারের পর ঝালকাঠিতে জালানী নিয়ে পাঠানো হলে আবার সুগন্ধা নদীতে এই দূর্ঘটনায় পতিত হয়। এর আগে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে একই কোম্পানীর সাগর নন্দিনী-৩ তেলবাহী জাহাজে একই ভাবে দূর্ঘটনায় ৭ জনের প্রান হানীর ঘটনা ঘটে। যার তদন্ত রিপোর্ট আজপর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এই কোম্পানীর মালিক গোপালগঞ্জ জেলার ব্যবসায়ী শেখ মোঃ হাফিজ।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT