3:53 pm , July 2, 2023
সাগর মোহনায় ট্রলার ডুবি
শহিদুল ইসলাম জামাল, চরফ্যাসন ॥ ভোলার চরফ্যাসনের সাগর মোহনার শিবচর এলাকায় ১৩ জন মাঝি মাল্লা নিয়ে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজের পাঁচদিন পর ৭ জেলের মধ্যে ৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে স্বজনরা। শুক্রবার মেঘনা নদীর শিবচর এলাকার তিন চরের সাগর মোহনা থেকে মৃত জেলেদের মরদেহ উদ্ধার করে সামরাজ ঘাটে নিয়ে আসেন স্বজনরা। এখনও নিখোঁজ রয়েছে এক শিশু জেলেসহ আরও দুই জন। রাতেই নিহত জেলেদের দাফন সম্পন্ন করা হলেও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে জেলে পরিবার গুলোতে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের অন্তহীন আহাজারীতে চর মাদ্রাজ ইউনিয়নের চর নিউটন গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। অনবরত কান্নায় স্বজনদের চোখের জল শুকিয়ে গেছে। কেউ গেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কখনো কখনো নি.শব্দ কান্না বুকফাঁটা আর্তনাদে বাতাস ভারী করে তোলে। শুক্রবার বিকালে ও শনিবার মাদ্রাজ ইউনিয়নের নিহত জেলেদের বাড়িতে গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। জানা যায়, সামরাজ ঘাটের জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন মাছ ধরা ট্রলারটি ১৩ মাঝি মাল্লা নিয়ে গত ২৫ জুন সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে সাগর মোহনায় তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায়। দূর্ঘটনার পরপরই ট্রলারে থাকা ১৩ মাঝি মাল্লার মধ্যে ট্রলার মালিক জাহাঙ্গীর আলম ও আবদুল গনিকে পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালীর জেলেরা নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করেন। পরে ২৮ জুন আবদুর রব , জাকির হোসেন , আনোয়ার ও জাকির আখন নামের আরো ৪ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও নিখোঁজ ছিলেন আরও ৭ জেলে। শুক্রবার জীবিত জেলেদের দেয়া তথ্যমতে নিখোঁজ জেলে পরিবারের সদস্যরা শিবচর ও তিনচর এলাকার সাগর মোহনায় ট্রলার যোগে অভিযান চালিয়ে ৫ জেলের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে সামরাজ ঘাটে নিয়ে আসেন। শনিবার দুপুরে নিহত জেলে সাত্তার হাওলাদারের চর মাদ্রাজ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে তিন সন্তানসহ স্ত্রী নুপুর বেগম স্বামীর জন্য আহাজারী করছেন। নিজস্ব কোন জমি নেই। বাবার বাড়িতে একটুরো জমিতে করা ভিটেতে বসবাস তাদের। স্বামী সাত্তার হাওলাদার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করে সংসার চালাতেন। স্থানীয় ব্যক্তি এবং অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ২ লাখ টাকার ঋণ আছে। কৃষি কাজে লোকসান হওয়ায় সাগরে মাছ ধরে অর্জিত আয় থেকে ঋণের কিস্তি দেবেন এমন আশা নিয়েই হতদরিদ্র সাত্তার সাগরে ভেসেছিলেন। ৫ম শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ে সুনিয়া দ্বিতীয় শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে সামিয়া ও ২ বছর বয়সী শিশু পুত্র সাহাদাতের ভরপোষন আর ২ লাখ টাকার ঋণের দায় মাথায় নিয়ে স্বামীর জন্য বিলাপ করছেন স্ত্রী নুপুর বেগম। অপর দিকে নিখোঁজ শিশু শিক্ষার্থী সিহাবের মামা নরুল ইসলাম জানান, সামনে ঈদ পরিবারের কর্মক্ষম বাবা ঈদে নতুন কাপড় দিবে না তাই ছোট সিহাব তার অর্জিত টাকায় নতুন কাপড় কিনবেন এমন আশায় ঘাটের জেলেদের সাথে মাছ ধরতে নদীতে যান। ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন শিশু শিক্ষার্থী সিহাব। শিশু পুত্রকে হারিয়ে পাগল প্রায় তার বাবা মা। এখন শুধুই কান্না আহাজারী আর আগামী দিনের অনিশ্চয়তার কালোছায়ায় ঘিরে আছে নিখোঁজ শিশু জেলে সিহাবের পরিবারে। প্রাণে বেঁচে ফেরা ট্রলারের মালিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, শিব চরের তিন চর এলাকায় জাল ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। হঠাৎ তীব্র ঢেউ ট্রলারের তলা ফেঁটে তাদের ট্রলারটি নদীতে তলিয়ে যায়। নদীর তীব্র ¯্রােতে চারদিকে ভেসে যান ১৩ জন জেলে। এক রাত সাগরে ভেসে থাকার পর তাকে এবং অপর এক জেলে আবদুল গনিকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পটুয়াখালীর রাঙ্গবালী ঘাটের একটি মাছ ধরা ট্রলার তুলে নেন। অপর জেলেরা কোথায় আছে তা তার জানা ছিলো না। সামরাজ ঘাটের আড়ৎ মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন পাটোয়ারী জানান, জীবিত উদ্ধার হওয়া জেলেদের তথ্য অনুযায়ী গতকাল ঘাট থেকে ২টি ট্রলারে করে নিখোঁজদের স্বজনরা দূর্ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান চালায়। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সাগর মোহনার তিনচর ও শিবচর এলাকা থেকে ৫ জনের লাশ উদ্ধার করে তারা এনে মরদেহ শনাক্ত করে পরিবারে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনও ২ জন নিখোঁজ আছে। চরফ্যাসন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার জানান, নুরুল ইসলাম, হারুন দর্জি, শরিফ হোসেন, ছাত্তার হাওলাদার, ফজলে করিম রারী ও নুর ইসলামের লাশ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে প্রথম চারজনের বাড়ি চরফ্যাসনের মাদ্রাজ ইউনিয়নে ও নুর ইসলামের বাড়ি একই উপজেলার এওয়াজপুর ইউনিয়নে। সিহাব ও রহিম মাঝি নামের ২জন নিখোঁজ আছে। নিহত এসব ছেলে পরিবারে নিবন্ধনের কাগজ যাচাই করে মৎস্য বিভাগে পক্ষ থেকে প্রত্যেক জেলেকে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। চরফ্যাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল নোমান জানান, ট্রলার ডুবিতে নিহত পরিবারকে নগদ ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের কর্মক্রম চলমান আছে।