4:40 pm , June 21, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ খুলনা শিপইয়ার্ড উপকুল রক্ষী বাহিনী ‘বাংলাদেশ কোষ্ট গার্ড’ এর জন্য আরো ৪টি বিশেষায়িত নৌযান নির্মাণের গৌরব অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার গনভবন থেকে ভার্চুয়ালী যোগ দিয়ে চট্টগ্রামে কোষ্টগার্ডের ঘাটিতে যে ৫টি নৌযানের আনুষ্ঠানিক কমিশনিং করেন, তার ৪টিই খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত। সরকারের নিজস্ব তহবিলের প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব নৌযান দেশে নির্মানের ফলে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা সাশ্রয়ের পাশপাশি উপকুল রক্ষী বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও যথেষ্ট সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছে কোষ্ট গার্ডের দায়িত্বশীল মহল।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সমুদ্র সীমা নির্ধারিত হওয়ায় আমাদের ‘ব্লু ইকোনমি’র অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার কোষ্ট গার্ডকে যুগপোযোগী করার উদ্যোগ গ্রহন করেছে। এ লক্ষ্যে ২০১৫ থেকে ’৩০সাল পর্যন্ত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা প্রনয়ন করে তারই ধারাবাহিকতায় ‘ইনশোর পেট্রোল ভেসেল’ ও ‘সেলফ প্রপেলড ফ্লোটিং ক্রেন’ সহ বিভিন্ন বিশেষায়িত আধা সামরিক ও অসামরিক বিশেষায়িত নৌযান নির্মান করা হচ্ছে। সদ্য কমিশনিং নৌযানগুলোর মাধ্যমে উপকুল রক্ষী বাহিনীটির আধুনিকায়নের ক্রমধারা আরো একধাপ এগিয়ে গেল।
বুধবার কমিশনিংকৃত নৌযাগুলোর মধ্যে খুলনা শিপউয়ার্ডে নির্মিত একটি ‘সেলফ প্রপোলড ফ্লোটিং ক্রেন’ ছাড়াও, ২টি ‘হাইস্পীড ডাইভিং বোট’, দুটি ‘টাগ বোট’ এবং আরা ২টি হাইস্পীড ফেরি বোট রয়েছে। ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নৌ জরিপ ও ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি ‘ব্যুরো ভেরিটাস’ এসব অসামরিক নৌযান সমুহের নির্মানকালীন পর্যবেক্ষন সহ কারিগরি মানের সনদ প্রদান করে। এসব নৌযানেই অত্যাধুনিক মূল ইঞ্জিন ও জেনারেটর ছাড়াও নেভিগেশন্যাল রাডার সহ সর্বাধুনিক নৌ সংকেত ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে।বুধবার কমিশনিংকৃত কোষ্ট গার্ডের নৌযান সমুহের মধ্যে খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত ১৩৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে ‘সেলফ প্রপোলড ফ্লোটিং ক্রেন’টি ৭০ টন পর্যন্ত উত্তোলন ক্ষমতা রয়েছে। নৌযানটি তার নিজস্ব ইঞ্জিনের সাহায্যে ৭০ টন পানি অপসারন করে ঘন্টায় ৮ নটিক্যাল মাইল বা প্রায় ১৫ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রমে সক্ষম। খুলনা শিপইয়ার্ডে তৈরী প্রায় ৬৭ ফুট দৈর্ঘ্যরে দুটি হাইস্পীড ডাইভিং বোট দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় এলাকায় যে কোন নৌ দূর্ঘটনায় উদ্ধারকর্মী সহ উদ্ধারকৃতদের জরুরী চিকিৎসা সহ তাদের জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। প্রায় ২০ ফুট প্রশস্থ এসব নৌযান ৫২ টন পানি অপসারন করে ঘন্টায় প্রায় ৩৩ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রমে সক্ষম ।বুধবার কমিশনিংকৃত আরো দুটি হাই স্পীড ফেরি বোট নির্মান করে খুলনা শিপইয়ার্ড কোষ্ট গার্ডের জন্য হস্তান্তর করে ইতোপূর্বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য নৌযানগুলোর সাথে এ দুটিও কমিশনিং করেছেন। দেশের অভ্যন্তরীন ও উপকুলীয় এলাকায় যেকোন জরুরী প্রয়োজনে বাহিনীর সদস্য ছড়াও উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দূর্ঘটনা পরবর্তিকালে বা দূর্যোগকালীন সময়ে বিচ্ছিন্ন এলাকায় নারী ও শিশুর মত ঝুকিপূর্ণদের জরুরী ও দ্রুত পরিবহন নিশ্চিত করতে এসব হাই স্পীড ফেরি বোট বিশেষ সহায়ক হবে। প্রায় ৫৫ টন পানি অপসারন করে যেকোন দূর্যোগ ও পরবর্তি সময়ে এসব হাই স্পীড ফেরি বোট ৪৬ জন আরোহী নিয়ে ঘন্টায় প্রায় ৩৪ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রমে সক্ষম।বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর নিয়ন্ত্রনাধীন খুলনা শিপইয়ার্ড কোষ্ট গার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাঝারী থেকে বড় মাপের যেকোন ধরনের নৌযান উদ্ধার সহ বন্দর বা পোতাঙ্গন থেকে যেকোন স্থানে অপসারনে প্রায় ৯৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে দুটি টাগ’ও নির্মান করেছে। এসব টাগ ৫৫৫ টন পানি অপসারন করে দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকুলীয় এলাকায় ঘন্টায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলতে সক্ষম বলে জানা গেছে। এসব টাগ’এ ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট সংযোজন করায় নৌপথে যেকোন অগ্নি নির্বাপন কাজেও সহায়ক ভুমিকা পালন করবে এ দুটি টাগ। বুধবার প্রধানমন্ত্রী এদুটি টাগও আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশনিং করেছেন।
বাংলাদেশ কোষ্ট গার্ড তার টহল নৌযানসমুহের সাহায্যে দেশের অভ্যন্তরীন ও উপকুলীয় এলাকায় চোরাচালান বিরোধী অভিযান ছাড়াও ইলিশ সহ মৎস্য সম্পদ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আশি^নের বড় পূর্ণিমার সময় সারা দেশে ইলিশ সহ উপকুলীয় প্রজনন এলাকায় সব ধরনের মাছ আহরন বন্ধে কোষ্ট গার্ডের ভুমিকা অপরিসীম। এমনকি গত ২৩ মে থেকে সাগরে সব ধরনের মৎস্য আহরন যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে, তা প্রতিপালনেও কোষ্ট গার্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের এ উপকুল রক্ষী বাহিনী যে কোন নৌযানের দূর্ঘটনা পরিবর্তি উদ্ধার অভিযান সহ দূর্যোগ পরবর্তি তৎপরতায়ও অংশ গ্রহন করে থাকে।
দেশের উপকুলীয় এলাকার কয়েক কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে। বিশ^ব্যাপী জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের উপকুলবাসীও মূক্ত নয়। ঝড়ঝঞ্ঝা আর জলোচ্ছাসের মত প্রকৃতিক দূর্যোগ তাদের নিত্য সঙ্গী। তবে এর পরেও তারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। আর উপকুলবাসীর নিরাপত্তা বিধান সহ তাদের জীবন মান উন্নয়নেও আমাদের কোষ্ট গার্ড কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোষ্ট গার্ডের উন্নয়নে সব ধরনের পদক্ষেপ ও প্রস্তাবনায় সম্মতি প্রদান করছেন বলে বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জনিয়েছেন। পাশাপাশি সরকার প্রধান কোষ্ট গার্ড সহ উপকুলবাসীর জীবনমান উন্নয়নে অত্যন্ত ইতিবাচক ভুমিকা পালন করছেন।
অপরদিকে ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৃতপ্রায় ও রুগ্ন শিল্পের তালিকাভুক্ত খুলনা শিপইয়ার্ড’কে নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে বিচক্ষনতার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি দেশের এ অমূল্য সম্পদ ধংশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। দেশের একজন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন খুলনা শিপইয়ার্ডকে নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর না করলে তা ইতিহাসের চেরাবালিতে হারিয়ে যেতে পারত বলেও মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। এমনকি খুলনা শিপইয়ার্ডের ঘুরে দাড়ান দেখে একই ভাবে রুগ্ন ও লোকসানী ‘নারায়নগঞ্জ ডকইয়াডর্’ ও ‘চট্টগ্রাম ড্রাইডক’কেও নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই অনেক আগেই লোকসান ও অব্যবস্থাপনাকে পেছনে ফেলে নতুন অগ্রযাত্রায় সামিল হয়েছে ইতোমধ্যে। খুলনা শিপইয়ার্ড করোনা মহামারী সংকটের মধ্যেও বিগত ৩টি অর্থ বছরে কর পরবর্তি প্রায় ২শ কোটি টাকা নীট মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে।