4:16 pm , June 17, 2023
২৪ বছর চলছে মামলা
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ২.১০ শতক জমির দখল নিয়ে ২৪ বছর ধরে একে-অপরের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। আর এই সুযোগে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে শক্তিশালী বাদীপক্ষ বিবাদী পক্ষের ঘর ভাংচুর করে তা দখলে নিয়েছে এবং হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও বাদীপক্ষের দাবী তাদের তৈরি ঘর তারা ভেঙেছেন এবং কোনোরকম মারামারি বা হত্যার হুমকি দেয়া হয়নি। আর প্রশাসন বলছে, আমাদের দায়িত্ব অপ্রীতিকর ঘটনা যেন ঘটে তা দেখা। সালিশে নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
ঘটনায় অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ডের পলাশপুরে কাউন্সিলর রনির বাড়ি সংলগ্ন হালিমা খাতুন শাহজাদি বেগমের সাড়ে চৌদ্দ শতক জমিতে বাদীপক্ষ শাজাহান খানের ১৭ শতক জমির ২.১০ শতক জমি রয়েছে দাবীতে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাদীপক্ষ শাজাহান খান ঐ জমি নিজের দাবী করে ২৪ বছর আগে (২৩৪/৯৯ নং মামলা ২৫/১০/৯৯) মামলা দায়ের করেন। যার বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন বিবাদী পক্ষ এবং এই মামলা আজো চলমান রয়েছে। এ অবস্থায় আদালতের আদেশ অমান্য করে শাজাহান খান ও তার লোকেরা হালিমা খাতুন শাহজাদির জমিতে প্রবেশ করে সেখানে থাকা ঘরের লোকদের বের করে দিয়ে জোরপূর্বক’ ভাঙচুর ও দখল চালায় এবং ঘরটি তাদের দখলে নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় কাউনিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী জমির মালিক হালিমা খাতুন শাহজাদি। সরেজমিনে শনিবার সকাল ১১ টায় পলাশপুর ৫ নং ওয়ার্ডে শাহাজাদী বেগম ওরফে হালিমা খাতুন স্বামী মৃত আলা বক্স মিয়ার বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, তার বাড়ির মোট ২৩ শতক জমির দুটি অংশ। একাংশ সাড়ে আট শতক এবং আরেক অংশ সাড়ে চৌদ্দ শতকের মাঝে রয়েছে দেয়ালের বিভাজন। সাড়ে চৌদ্দ শতকের অংশ নিয়েই চলছে ঝামেলা ও মামলা। এই জমির পিছনের অংশ উল্টো এল আকৃতির। সেখানে রয়েছে একটি দোতলা টিনের ঘর। যার প্রবেশপথ দক্ষিণে এবং তা স্পষ্ট প্রমাণ করে এটি সাড়ে চৌদ্দ শতকের মালিকানার অংশ। ঘরটির সামনের অংশে তালা ঝুলছে। বিবাদী হালিমা খাতুন শাহজাদির মেয়ে সাদিয়া আক্তার তালা খুলে ঘুরে দেখাতে চাইলে সেটি ভিতর থেকে বন্ধ পাওয়া যায়। এসময় বাদীপক্ষ শাজাহান খানকে ফোন করলে তিনি ছুটে আসেন ও ঘরের ছবি বা ভিডিও করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে হম্বিতম্বি করেন। তার দাবী ঐ ঘর তিনি তৈরি করেছেন। তার প্রয়োজনে তিনি ভেঙেছেন ও পিছন অংশ ভেঙে তিনি প্রবেশ করেছেন। কারণ সামনের অংশ বিবাদী পক্ষ তালা দিয়ে রেখেছে।
শাজাহান খান এই ঘরের কোনো ছবি তুলতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটার মামলা চলমান রয়েছে। তাই এ নিয়ে আমি এখন কিছুই বলবোনা। তিনি তার পক্ষে রায় হয়েছে দাবী করে কিছু কাগজও দেখান যেখানে লেখা আছে – উপরোক্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্তের আলোকে বিচার্য বিষয়টির সিদ্ধান্ত আপীলকারী পক্ষের প্রতিকুলে গৃহীত হল ।
আদেশ হয় যে, অত্র দেওয়ানী আপীলটি দোতরফা শুনানী অন্তে সংশোধিত আকারে নামঞ্জুর করা হল । গত ১৬ এপ্রিল বিভাগীয় স্পেশাল জজ মেহেদী আল মাসুদ নামের উল্লেখে এই রায় দেখানো হয়। এ সময় ঘর ভাঙার আদেশ বা এ জাতীয় কোনো কথা হয়েছে কিনা প্রশ্নের উত্তরে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) হরিদাস নাগের নম্বর দিয়ে কথা বলতে বলেন। পরিদর্শক হরিদাস নাগ জানান, তিনি নয়, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আব্দুর রহিম। তবে তিনি এটি সম্পর্কে জানেন এবং বিএস গেজেট অনুসরণ করে আদালত এটি নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছে বলে জানান হরিদাস নাগ। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিবাদী পক্ষের ফোন পেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আব্দুর রহিম ছুটে আসেন এবং বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে দু’পক্ষই এখন যার যার অংশে ঘর তালাবদ্ধ রাখতে পারবে।
তিনি বলেন, এটি থানায় নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেয়া হলেও পুলিশের দায়িত্ব শুধু কোনোরকমে অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে তা দেখা। বিএস গেজেট অনুসরণ করে আদালত এটি নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন বিষয়টি বাদী ও বিবাদী উভয়ের লোকজন ও আদালতের এক্তিয়ার বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুর রহিম।
ঘটনার বিবরণ ও মামলার নথিপত্র ঘেটে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর আমানাতগঞ্জ মৌজার এসএ ২১৭৬ নং দাগ ৯০৭, ১৪৭৪, ৮৭৬ দাগ ১৪৫০ শতাংশ জমি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এই বিরোধ চলছে। ক্রয়সূত্রে ওই সম্পত্তির দাবিদার হালিমা খাতুন শাহজাদি বেগম। একই দাবীতে প্রতিবেশী শাজাহান খান ১৯৯৯ সালের প্রথম এই জমিতে তার ২.১০ শতক জমি রয়েছে বলে মামলা দায়ের করেন।
২০১৬ সালে বিষয়টি জানতে পারেন হালিমা খাতুন শাহজাদি বেগম। তিনি বরিশাল বিভাগীয় স্পেশাল জজ ও স্পেশাল জেলা জজ দেওয়ানি আপিল নং (১৮/২০১৬)তে পাল্টা মামলা দায়ের করেন। এই মামলা চলমান অবস্থায় তাদের পরষ্পরের অভিযোগের ভিত্তিতে আদালত ওই সম্পত্তিতে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন ও পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যার যার অবস্থানে থাকতে বলেন। অথচ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে শাহজাহান খান সহ তার সহকারী মান্নান, মিরাজ খান, ইমাম খাম, নয়ন, হাসান, বাবু নাইম, হারুন, সেকনি আবুল, মিরাজের বউ কলি, ইমামের বউ দিবা, খালেদা সহ ১৫, ২০ জনের একটি দল নিয়ে জোরপূর্বক জমি দখলের চেষ্টায় দোতলা টিনের ঘরটির পিছনের অংশ ভাঙচুর করে তা দখলে নেয়। এ ঘটনায় কাউনিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী জমির মালিক হালিমা খাতুন। অভিযোগে জানা যায় ২৭ মে সকাল ৯ টা ৩০ মিনিটের দিকে ওই বাড়ির ভাড়াটিয়ারা বিল্ডিং ভাঙ্গার শব্দ পায়। এরপরে মালিকের ছোট মেয়ে ঘটনা স্থলে গেলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে এবং তাকে জোর করে ঘর থেকে বের দেয়া হয়। শাজাহান খানের বড় ছেলে-ছোট ছেলে ও ছেলে বউরা এসে এই ঘর দখলে নেতৃত্ব দেয়। এই ঘটনার পর পরই ভুক্তভোগী হালিমা খাতুন শাহজাদির মেয়ে সাদিয়া ৯৯৯ ফোন দিলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও শান্ত করে এবং উভয়পক্ষকেই জমির কাগজ ও মামলার কাগজ নিয়ে বসার পরামর্শ দেয়। এ সময় বরিশালের স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন । সাংবাদিকরা ঘটনা স্থানের ছবি তুলতে গেলে শাজাহান খান সাজু তাদেরও বাধাগ্রস্ত করেন।বাড়ি দখল করার ব্যাপারে শাহজাহান খান এর কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন আমি আদালতের রায় পেয়েছি তাই বাড়ি দখল দিছি, অথচ আদালতে মামলা চলমান তিনি বাড়ি দখল দেওয়ার ব্যাপারে আদালতের লিখিত রায় পেয়েছেন এমন কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।গত মে মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সেখানে ঐ ঘটনার সাক্ষী কাউনিয়া থানার এসআই হান্নান বলেছেন, আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। ঘর ভাঙচুরের ও জমি দখলের প্রমাণ পেয়েছি। শাজাহান খান ঘর ভাঙচুর করছে, এ ঘটনা সত্যি। দু পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে, কিন্তু একপক্ষ আসেনি এখন বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে সমাধান করা হবে।একই সময় কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুর রহমান মুকুল হোসেন বলেন, শাজাহান খান ঘর ভাঙচুর করেছে এটা দ-নীয় অপরাধ। শাহজাহান খান আগে ঘরবাড়ি ঠিক করে দেবে, তারপরে দুইপক্ষ নিয়ে বসা হবে। এ ঘটনার একমাসের ব্যবধানে ১৭ জুন বিষয়টির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে ওসি মুকুলকে ফোন করা হলে তিনি জানান, নির্বাচন এসে পরায় বিষয়টি বিলম্ব হয়েছে। একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই তিনি দু-পক্ষকে নিয়ে বিষয়টি সমাধান করবেন বলে জানান ওসি মুকুল।