4:04 pm , May 23, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ সামুদ্রিক এলাকায় বিপন্ন মাছের অস্তিত্ব রক্ষা সহ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও পাশ^বর্তী দেশের জেলেরা এ সুযোগে আমাদের মাছ লুটে নেয়ার চেষ্টা করছে। ১৯ মে মধ্যরাত থেকে কার্যকর আহরণ নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে নৌ বাহিনী, কোষ্টগার্ড ও র্যাব ছাড়াও নৌ পুলিশকে সতর্ক নজরদারীর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কিন্তু নৌ বাহিনী ও কোষ্টগার্ড ছাড়া নৌ পুলিশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের কাছেও কোন টহল নৌযান না থাকায় নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না ওইসব সরকারী দপ্তর।
দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষিরা থেকে দক্ষিণের কুয়াকাটা হয়ে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা এবং সমুদ্র অভ্যন্তরের ২শ নটিক্যল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’য় এ নিষধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। ফলে জেলে নৌকা ও ট্রলারসমূহ এখন সব উপকূলের বিভিন্ন পোতাশ্রয়ে। এসময়ে উপকূলীয় সব মৎস্য আড়ত বন্ধ রাখা ছাড়াও বরফ কলগুলোকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কোন বরফ কল থেকে একসাথে ১০ ক্যানের বেশি বরফ বিক্রী করতে দেয়া হবে না। শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে মৎস্য শিকাররত জেলেদের কাছেই বরফ বিক্রী করা যাবে বলে মৎস্য অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেবে দেশে বছরে আহরিত প্রায় ৪৫ লাখ টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে এককভাবে সামুদ্রিক মাছের পরিমান প্রায় ৭ লাখ টনেরও বেশী। দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ১৫%। মৎস্য অদিপ্তরের মতে, সমুদ্র এলাকায় প্রায় ৫.১৬ লাখ জেলে ২৫৫টি বানিজ্যিক ট্রলার ছাড়াও প্রায় ৩৩ হাজার ইঞ্জিনচালিত ও ৩৫ হাজার ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় নানা সরঞ্জামের সাহায্যে মৎস্য আহরণ করেন।
বাংলাদেশের দক্ষিন সীমানাজুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ এর মাথায় যে রূপালী ঊর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বঙ্গোপসাগরও। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী ‘সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরণ, ভূমি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখি সংকটের সম্মুখীন। ফলে বাংলাদেশের মত বিশে^র মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মৎস্য সম্পদের টেকসই উন্নয়নে সাময়িক এ নিষেধাজ্ঞার বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন মৎস্য অধিদপ্তর।
আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে সরকার সাগরে মৎস্য শিকারে নির্ভরশীল প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার জেলে পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৮৬ কেজি করে সর্বমোট ১২ হাজার ৬৫০ টনের মত চাল বিতরণ করতে যাচ্ছে। আগামী মাসের প্রথমভাগেই এসব চাল বিতরণ সম্ভব হবে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক জানিয়েছেন।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ৪০ হজার ৮৬০ বর্গ কিলোমিটারে ছোট-বড় নানা প্রকারের ৪৭৫ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। আমাদের সমুদ্র এলাকায় ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবালসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী সমুদ্র সম্পদকে সমৃদ্ধ করেছে।
সরকার চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করা সহ অন্যান্য মাছের বিচরন, প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আহরণ প্রবৃদ্ধি টেকসই করতেই ২০১৫ সালে শুধুমাত্র বানিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে এবং ২০১৯ সাল থেকে সব ধরনের নৌযানের জন্য বঙ্গাপসাগরে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, শুধুমাত্র সামুদ্রিক এলাকায় ৬৫ দিনের এ আহরণ নিষেধাজ্ঞার ফলে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় দেড় লাখ টন বাড়তি মাছ যোগ হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ৬৫ দিনের বন্ধ মৌসুম কার্যকরের আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ থেকে ’১৪-১৫ সময়ের তুলনায় ২০১৫-১৬ থেকে ’১৭-১৮ পর্যন্ত বানিজ্যিক ট্রলার থেকে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় মৎস্য আহরণের পরিমান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সামুদ্রিক জলাশয়ে উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। যা ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৬.৮০ লাখ টনের ওপরে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষনে বঙ্গোপসাগরে আমাদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে মলাস্ক বা শামুক ও ঝিনুকের প্রজাতির সংখ্যা ৩০১ টি, অস্থিময় মাছ ৪৭৫টি, হাঙ্গর ও স্কেট সহ তরুনস্থিময় মাছের প্রজাতি ৫১টি, চিংড়ি ৩৬টি, লবস্টার ৮টি, কাঁকড়া ১৫টি, ডলফিন বা তিমি ১১টি, সামুদিক কচ্ছপ ৫টি, সাপ ৯৮টি সেপালোপেড ৭টি, স্টার ফিস ৩টি, ওয়েস্টার ৬টি, সজারু ১টি, সাগর শশা ১টি এবং ১৬৮ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির প্রবাল ও ৩ প্রজাতির স্পঞ্জ রয়েছে।
কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে অনিয়ন্ত্রিত আহরণের ফলে সাগরে ফলি, চান্দা, সার্ডিন বা চাপিলা, বস্তার পোয়া প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। লক্ষা মাছও অতিরিক্ত আহরণে প্রায় নিঃশেষ। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এ অবস্থায় যেকোন মাছ বানিজ্যিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবার প্রবল ঝুঁকি থাকে। কার্যকর সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এসব প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্তির আশংকার কথাও জানিয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা। তবে রূপচাঁদা, কলম্বো, মরিচ এবং সাদা পোয়া মাছ এখনো সহনীয় আহরণে তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বঙ্গোপসাগরে আমাদের নিজস্ব অথনৈতিক অঞ্চলে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অবিলম্বে আহরণে নিয়োজিত নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি রহিতসহ তা কমিয়ে আনা জরুরী। ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রয়োগ এবং তার সুফল ধরে রাখতে বেশ কিছু বছর ধরে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখাসহ সুফল পেতে সুনির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভেদ ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করার কথাও বলেছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।