3:46 pm , May 12, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল সহ সারাদেশেই এই মুহুর্তে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। বহুদিন হলো ব্যাগভর্তি বাজারের গল্প করে না মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ। খেটে খাওয়া দিন মজুরদের মুখের হাসি মুছে গেছে অনেক আগেই। কেমন আছেন এ প্রশ্ন খেটে খাওয়া ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন কেউ ভালো নেই বলে জানিয়েছেন।
হঠাৎ করে দুই দফায় চিনির দাম বাড়ার কারনে রং চায়ের আড্ডাটাও ভেস্তে যাওয়ার কষ্ট চোখে মুখে। গত ১১ মে খোলা চিনির দাম কেজিপ্রতি ১৬ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে আগে থেকে অস্থির চিনির বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়েছে। ১৪০ টাকার কম কোথাও খোলা চিনি মিলছে না। আর বাজারে প্যাকেটজাত চিনিতো কয়েক সপ্তাহ ধরেই উধাও। অন্যদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে দুদিন আগেই। যা আগে ছিল ১৮৭ টাকা। তবে নতুন দামের তেল এখনো আসেনি সবখানে। কিন্তু পুরোনো দাম লেখা মোড়কের বোতলও বাজারে বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে। মুদি দোকানে লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর খবরের সঙ্গে সঙ্গে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারাও সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও পুরনো তেল লিটারে ১২ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে না। লিটারপ্রতি ৩-৮ টাকা পর্যন্ত বেশিতে নিতে দেখা গেছে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মোড়কে দাম ১৮৭ টাকা লেখা অথচ সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। ৩৭৪ টাকার দুই লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৩৮০-৩৯০ টাকায় এবং ৯০৬ টাকার ৫ লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৯১৫-৯২০ টাকায়।
তেল চিনির প্রভাব পড়েছে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপরও। পিয়াজ, সবজি, মাছ, মাংস সবকিছুই যেন এখন অধিক দামে কিনতে হচ্ছে।
বিসিক শিল্প নগরীর জেআইবি ফুড ফ্যাক্টরির এ্যাডমিন অফিসার সুলতানা বাজার থেকে ফিরে যাচ্ছেন মলিন মুখে। বিষন্ন কণ্ঠে জানালেন, একসপ্তাহের বাজারের জন্য আমার বাজেট মাত্র ১২শ টাকা। আজ এই পোর্টরোড বাজার ঘুরে বুঝতে পারছি, আমার জন্য খোলা নেই এ বাজার। তিনি বলেন, একেতো শুক্রবার। সকালের বাজারে উপচে পড়া ভীড়ে মহিলাদের কেনাকাটা খুবই দুষ্কর। তার উপর গত কয়েকদিনের প্রচ- গরমে দিশেহারা অবস্থা। এমতাবস্থায় যখন সবজি পেপের কেজি হয় ৮০ টাকা আর ২৫ টাকার আলুর দাম হয় ৩৫-৪০ টাকা তখনতো মাথায় বাজ পড়লো বলেই মনে হয়।
দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকার ব্যবস্থাপক আরিফুর রহমান জানান, আগে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে পরিবারের পুরো সপ্তাহের বাজার হয়ে যেত। এখন দাম বাড়ায় ওই টাকায় প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই কেনা সম্ভব হচ্ছে না। গুনতে হচ্ছে আরও কয়েকগুণ বেশি টাকা। দাম বেশি হওয়া ও পকেটে হিসাবের বাড়তি টাকা না থাকায় কিছু পণ্য বাদ রেখেই বাজার থেকে বাড়ি ফিরছেন তিনি।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সুলতানা ও আরিফুর রহমানের মত অবস্থা অধিকাংশ ক্রেতার। সাধ্যের মধ্যে ভরছে না তাদের বাজারের ব্যাগ। মাছ-মাংস, শাক-সবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দামে বিপাকে সাধারণ মানুষ। বিশেষত নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি বেকায়দায় পড়েছেন। বাধ্য হয়ে পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন তারা।
শুক্রবার বরিশালের পোর্ট রোড, বাংলা বাজার, নতুন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগে থেকে চড়া দামের অনেক পণ্যের দাম নতুন করে আরও বেড়েছে। এসব পণ্যের সহসা দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আটা ৬৫ আর আঠাশ চাল ৬০ টাকা দর । নতুন করে এগুলোর দাম না বাড়লেও বেশ আগেই বেড়ে বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মসলার বাজারে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম। ঈদের পর থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৩০-৩৫ টাকা বেড়ে এখন ৭০ টাকায় ঠেকেছে। যা দুদিন আগেও ৬০-৬৫ টাকা ছিল। এছাড়া প্রতি কেজি আদা কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩০০ টাকার কিছু কম বা বেশি। যা গত বছর একই সময় ছিল ৯০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এখন আদার দাম তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। আর ঈদের পর থেকে বেড়েছে কেজিতে মানভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা। অন্যদিকে আমদানি করা চায়না রসুনের কেজিপ্রতি দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়। মুদিপণ্য আর মসলাই নয়, সবজি ও মাছের বাজারও পুড়ছে বাড়তি দামের আগুনে। বাজারে এখন আলু ছাড়া অন্য কোনো সবজির কেজি ৬০ টাকার কমে মিলছে না। পেঁপে ও মূলার মতো তুলনামূলক কম চাহিদার সবজির কেজিও উঠেছে ৮০ টাকায়। যা নি¤œআয়ের মানুষের জন্য খুবই অস্বাভাবিক। এতদিন কমের মধ্যে থাকলেও আলুর দাম গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। মোটা দাগে দারুণ অস্বস্তি এখন সবজির বাজারে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত দু-তিন দিনের ব্যবধানে নতুন করে সবজির দাম আরও বেড়েছে। এখন বাজারে প্রতি কেজি বেগুন, পটল, মূলা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা, ঝিঙে, ধুন্দল, করলা, কাকরোল, বরবটি, ভেন্ডি, চিচিঙ্গা ৮০-১০০ টাকা, সজনে ১২০-১৪০ টাকায়।
এদিকে মাছ বাজারে ২২০ টাকা কেজির কমে তেলাপিয়া বা পাঙ্গাস মাছও কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। চাষের রুই-কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৩৫০ টাকায়। আর দেশি উন্মুক্ত জলাশয়ের শিং, টেংরা, বোয়াল খেতে গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
ঈদের কিছুদিন পর থেকে মাছের চাহিদা বেড়েছে। তখন থেকেই প্রতিদিনই আড়তে মাছের দাম বাড়ছে। বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন মাছের দাম কেজিতে ৫০-১০০ টাকা বেশি।
একই চিত্র মাংসের বাজারে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকার মধ্যে। আর প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম ১৪০ টাকা। এছাড়া গরুর মাংস ৮০০ টাকা ও খাসির মাংস ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাজারের এমন পরিস্থিতিতেও চলতি মাসের টিসিবি পণ্য বন্ধ। জানা গেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুধু বরিশাল নয়, পাঁচ সিটিতেই আপাতত বন্ধ আছে টিসিবি পণ্য সেবা।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সোহেল মারুফ বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় বন্ধ থাকলেও উপজেলার কার্যক্রম চলবে। তবে এই মুহুর্তে চিনি নিয়ে সংকট চলছে। পর্যাপ্ত চিনি এখনো বুঝে পায়নি বরিশাল টিসিবি। তাই চলতি মাসের শেষে হয়তো টিসিবি পণ্য বিক্রি শুরু হতে পারে বলে জানান তিনি।