4:36 pm , May 8, 2023

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ সকালে বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদরে পৌঁছাতেই একটি দুঃসংবাদ নিয়ে যাত্রা শুরু জলো ডিবিসি ইলেকশন এক্সপ্রেসের। এখানে নেয়ামতি ইউনিয়নের চামটা নতুন বাজার আগুনে পুড়েছে সাতটি দোকান। এতে একজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে বলে জানা গেছে এবং গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে ষড়যন্ত্রমূলক এই অগ্নিকা-ের ঘটনা। সোমবার সরকারি বাকেরগঞ্জ কলেজ মাঠ থেকে ডিবিসির লাইভ শুরু হয়। আশপাশের ব্যবসায়ী, খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের অনেকেই আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসেন তাদের কষ্টের কথা জানাতে। কিন্তু ডিবিসি ইলেকশন এক্সপ্রেস বাছাইকৃত প্যান্ট জুতো পড়া ভদ্রলোকদের বক্তব্য নিলেও লুঙ্গি গামছা গায়ের মানুষগুলো কোনো কথা বলার সুযোগই পেলেন না। তাদের মলিন মুখের অভিযোগ – এরা কি শুধু শিক্ষিত লোকের কথা শুনতে এসেছে, তাইলে মোগো ডাকেছে ক্যা? ‘বাংলার চিঠি’ ইউটিউব চ্যানেলটি তখন এগিয়ে এসে ধারণ করে সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা। পৌর এলাকার বেশিরভাগ সড়কসহ গত পনেরো বছরে ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা খুব একটা উন্নয়ন দৃশ্যমান নয় বলে অভিযোগ তাদের। এমনকি বর্ষা এলে কয়েকটি সড়কে ধান রোপণ করেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম চুন্নু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু গার্মেন্টস ব্যবসায়ী চুন্নু এলাকায় খুবই কম আসেন বলে জানালেন নেয়ামতি ও দাঁড়িয়ালের বাসিন্দারা। তারা বলেন, তিনি যদি এলাকায় আসেনও ঐ তার বাড়ি চরামদ্দি পর্যন্তই, এখানকার আওয়ামী লীগের সাথে তার খুব একটা বনাবনি নেই। এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়ার সাথে তার দ্বন্দ্ব বলে জানান গ্রামবাসী। আর লোকমান ডাকুয়া তার এলাকায় শুধু মাত্র নিজের ১ নং ওয়ার্ড ছাড়া আর কোথাও কোনো সড়কের উন্নয়ন করেন নাই। যা সচক্ষে দেখা গেল ২ নং ওয়ার্ড ও এমপি রতœা আমিন এর বাড়ির সড়কে। যদিও এমপির বাড়ির সামনের সড়কটি এলজিইডির দায়িত্বে বলে জানালেন পৌরসভার একজন কর্মী সোহেল। তবে এলাকাবাসীর দাবি, লোকমান ডাকুয়া জাতীয় পার্টি, বিএনপির নেতার বসবাস আছে এমন সব এলাকায় কোনো উন্নয়ন করেনি আজ পর্যন্ত। আর এমপি রতœা আমিনকে তারা চোখেও দেখেন নাই গত চার বছরে। এখানে নেয়ামতি, দুধল, চরামদ্দি, দাঁড়িয়াল ও পাদ্রী শিবপুর সবচেয়ে অবহেলিত এলাকা। এখানে ১৪টি ইউনিয়নের ১৭২টি গ্রাম ও একটি পৌরসভার মোট লোকসংখ্যা ২০১৮ সালের হিসেবে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯০৯ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬ জন এবং মহিলা ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৩৩ জন। এটি জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা। যেখানে ২০১৮ সালের হিসেবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৫৯ জন ভোটার রয়েছে। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২২ হাজার ৭৮৬ ও নারী ভোটার ১ লাখ ২২ হাজার ৩৭৩ জন। এখানে বাসস্ট্যান্ড থেকে উপজেলা পরিষদ যেতে সড়কটির খুবই বেহাল দশা। এটাই মূলত এমপির বাড়ি ও উপজেলা পরিষদের সড়ক। পৌরসভা ও এলজিইডির মধ্যে টানাটানিতে সড়কের এই হাল বলে জানালেন এলাকাবাসী। তবে এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের মিয়া এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার সজল চন্দ্র শীলের দাবী সদর রোড হিসেবে পরিচিত বাহেরচর পর্যন্ত এ সড়কটি মূলত পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে। তারা প্রবেশ অংশের আরসিডি সড়কের নির্মাণ করে থেমে গেছে। বাকীটা করতে না পারলে আমাদের অনুরোধ জানালে আমরা করে দিতে চেষ্টা করবো। সেজন্য পৌর মেয়র ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুমতিপত্র পেলেই আমরা প্রসেসিং শুরু করতে পারি। তবে এ নিয়ে কথা বলতে রাজী হয়নি পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়া। একসময় দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী হিসেবে খ্যাত বাকেরগঞ্জের আজ চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। দেশের সবচেয়ে বেশি নদী ও খালের প্রাদুর্ভাব এই অঞ্চলে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সেতু আর কালভার্টের প্রয়োজন অপরিহার্য বলে স্বীকার করেন নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের। ২০০৮ সাল থেকে এ আসনটি মহাজোট তথা জাতীয় পার্টির দখলে রয়েছে। রুহুল আমিন হাওলাদার এখানের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রী পরিষদে দীর্ঘদিন মন্ত্রী থাকার পরও এ অঞ্চলের তেমন উন্নয়ন চোখে পড়েনি। এরপর আসনটিতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। আর এভাবে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হলে আগামীতেও এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রেসিডিয়াম সদস্য বর্তমান এমপি নাসরিন জাহান রতœা আমিন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকিট পেয়ে আসনটিতে সংসদ সদস্য হন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যক্ষ মো. ইউনুস খান। তার মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সালের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন বিএনপির তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা) অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ খান। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম আনোয়ার চৌধুরী বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী হলেও একই বছরের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে হটিয়ে আসনটি দখল করেন আওয়ামী লীগের মাসুদ রেজা। ২০০১ সালে জাসদ থেকে বিএনপিতে এসে আবুল হোসেন খান এখানে সংসদ সদস্য হন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে বিএনপির আবুল হোসেনকে হারিয়ে নির্বাচিত হন মহাজোটের প্রার্থী রুহুল আমিন হাওলাদার এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার স্ত্রী নাসরিন জাহান রতনা আমিন সংসদ সদস্য হন। বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন এখনো আগামী নির্বাচনে আলোচিত নাম। এরপরই আছেন সাবেক কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন, উপজেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক আলহাজ্ব হারুন অর রশিদ সিকদার, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব নাসিরুদ্দিন হাওলাদারসহ আরো অনেকে। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে নাসিরুদ্দিন হাওলাদার বলেন, গত ১৫ বছরে ১৫ দিনও বর্তমান এমপি রতœা আমিন এলাকায় থাকেননি। উন্নয়ন হবে কি করে। তারউপর আওয়ামী লীগের অনেকেই তাদের পছন্দ করেননা। যে কারণে বরাদ্দ আনতে ব্যর্থ তিনি। যতটুকু উন্নয়ন দেখছেন তার সবটাই আমাদের সময়ে হয়েছে। কিছু কিছু সেতু অবশ্য তারা কাজ শুরু করেছে, কিন্তু নিজদের কোন্দল ও অদক্ষতার কারনে তা আটকে আছে আধাআধি হয়ে। তিনি এ সময় গোমা সেতুর উদাহরণ তুলে ধরেন। যা কাজ শুরুর পর বিভিন্ন জটিলতায় আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি বলে জানান নাসিরুদ্দিন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন উপদেষ্টাম-লীর সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ মল্লিক, বাকেরগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সামসুল আলম চুন্নু, পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়া, সাবেক সংসদ (১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের) সদস্য প্রয়াত মাসুদ রেজার স্ত্রী জেলা পরিষদের সদস্য আইরীন রেজা ও বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল হক মঞ্জু, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বাস মতিউর রহমান বাদশাসহ আরো অনেকে। ডিবিসি ইলেকশন এক্সপ্রেস বরিশালের শেষ দিনে শেষ আসনে যুক্ত হয়ে বাদশা বলেন, জোট নয়, আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী প্রয়োজন এই আসনে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে এ অঞ্চলের দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি এই একটি কারণে। যে কারণে তার নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাই তিনি ঠিক করতে পারেন নাই। এজন্য এই আসনে দলীয় প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগের তৃনমূল নেতাকর্মীরা। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্মা আমিন এর পক্ষে বাকেরগঞ্জ উপজেলার দলীয় সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক বলেন, যারা উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ করছে, তারা শত্রুতাবশত এটা করছে। কিছু কিছু স্থানে নি¤œমানের ঠিকাদারি কাজের কারণে আমাদের দূর্নাম হয়েছে। এমপি মহোদয়ের বাড়ির সামনের সড়কটি পৌরসভার সড়ক দাবি করে আজ পর্যন্ত পড়ে আছে। এ অঞ্চলের যেটুকু উন্নয়ন অবদান তার সবটুকুই আমাদের নেতা রুহুল আমিন হাওলাদারের কৃতিত্ব। তিনি এ অঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন। মানিক আরো বলেন, সেই সময়ের উন্নয়নের সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার দেশব্যাপী উন্নয়ন পদক্ষেপের সুফলও ভোগ করছে বরিশালবাসী। এসময় ফোনে যুক্ত হয়ে চরামদ্দি ইউনিয়নের সঠিখোলা বোর্ডস্কুল দাঁড়িয়াল ও নেয়ামতির অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো বরাদ্দ পাওয়া মাত্র দ্রুত নির্মানের আশ্বাস দেন বরিশাল ৬ আসনের সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রতœা আমিন। সন্ধ্যা ছটার লাইভ শেষে বরিশালের বরিশাল ত্যাগ করে ডিবিসি ইলেকশন এক্সপ্রেস।