4:31 pm , May 8, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ অব্যাহত তাপ প্রবাহের ফলে এবার বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় বোরো ধান আগাম পাকতে শুরু করেছে। মাঠে মাঠে ফসল কাটা শুরু হলেও ঘূর্ণিঝড় ‘মোচা’ নিয়ে শংকিত কৃষি যোদ্ধা ও কৃষিবিদগনও। কৃষি যোদ্ধাগন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধান কাটতে মাঠে থাকলেও গত কয়েকদিনের অব্যাহত তাপ প্রবাহে ধান কাটা ব্যাহত হচ্ছে। আবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় কৃষকের কপালের ভাজ গভীর হচ্ছে। আবাদকৃত ৩.৭০ লাখ হেক্টর বোরো ধানের প্রায় ৭৫ ভাগই এখনো মাঠে। এবার প্রায় ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলে বোরো আবাদ লক্ষ্য অতিক্রম করলেও মাঝপথে সারের মূল্য বৃদ্ধি উৎপাদনব্যয় বৃদ্ধির সাথে ধানের ন্যায্য দাম প্রাপ্তি নিয়েও মহা দুঃশ্চিন্তায় কৃষি যোদ্ধাগন। সোমবার পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের মাঠে প্রতিমন বোরো ধান বিক্রি হচ্ছিল সাড়ে ৯শ থেকে ১১শ টাকার মধ্যে। গত বছর ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির সাথে গত আগষ্ট থেকে চলতি রবি মৌসুমে দু দফায় সারের দাম ২০ টাকা বৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় মনপ্রতি প্রায় সাড়ে ৯শ টাকায় উন্নীত হয়েছে। তবে বাজারে এখনো বর্ধিত দামেও সার মিলছে না। ফলে বাস্তবে বোরো উৎপাদন ব্যয় আরো বেশী বলে মনে করছেন কৃষিবিদগন। সমাপ্ত প্রায় রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮০ হেক্টর আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩.৭০ লাখ হেক্টরে আবাদ সম্পন্নের কথা বলেছে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই। তবে ১০ লক্ষাধিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি এখনো প্রায় পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর বিধায় বঙ্গোপসাগর থেকে বার বার ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলের কৃষির সাথে কৃষকেরও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। ফলে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোচা’ তৈরীর যে আশংকা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়েও শংকিত দক্ষিণের কৃষকগন। তবে এবার বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় বড় কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ না ঘটলে দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে উদ্বৃত্তের পরিমান ১১ লাখ টনের কাছে পৌছবে বলেও আশাবাদী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। নদীবহুল দক্ষিণাঞ্চল সহ সারা দেশে এখনো সেচ ব্যয় সারা বিশ্বের সর্বাধিক ২৮-৩০%। ফলে উৎপাদন ব্যয়ও বেশী। কিন্তু চালকল মালিকদের নিয়োজিত ফরিয়া সিন্ডিকেটের কারণে ধানের দামে কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রনালয়ের এক পরিসংখ্যানে আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের মরুময় পাঞ্জাবে সেচ ব্যয় মোট উৎপাদন ব্যয়ের মাত্র ১৩%। যা থাইল্যান্ডে ৮% ও ভিয়েতনামে মাত্র ৬% । উপরন্তু গতবছর ডিজেলের মূল্য ২৩% বৃদ্ধির ফলে দেশে সেচ ব্যয় প্রায় ৩০%-এর ওপরে পৌছেছে বলে শংকা মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদদের। অপরদিকে দেশে সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের উপর সরকার ২০% ভর্তুকি দিলেও অধিক ব্যয়ের ডিজেলের ক্ষেত্রে তা এখনো অনুপস্থিত। দক্ষিণাঞ্চলে বোরো সেচাবাদে ব্যবহৃত পানির উৎসের প্রায় ৮৫ ভাগই ডিজেল চালিত সেচযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল বলে ডিএই’র পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। ফলে বোরো সেচ-আবাদে বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারন সহ ডিজেলের ওপর ভর্তুকি প্রদানেরও তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগন। উপরন্তু সম্প্রতি সারের দাম আরো একদফা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় আরো বেড়েছে। তবে সব বাঁধা ছাপিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে এখন সোনালী ধান কাটছেন কৃষিযোদ্ধাগন। ডিএই হিসেবে ইতোমধ্যে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলার প্রায় ২৫ ভাগ ধান ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ঢালু ও ভাটি এলাকা বিধায় দক্ষিণাঞ্চলে বোরোর আবাদ বিলম্বিত হয়ে থাকে। এমনকি কোন কোন এলাকায় ১৫ মার্চ পর্যন্ত বোরো আবাদ করেন কৃষকগন। ফলে জুনের শেষ ভাগ পর্যন্ত বোরো ধানের কর্তন চলবে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘মোচা’ নতুন শংকা তৈরী করছে। কারণ এধরনের ঘূর্ণিঝড়ে ভর করে প্রবল বর্ষণে সব ভেসে যায়। ফলে ঘূর্ণিঝড় মোচা কোন পথে উপকুলে আঘাত হানে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষনের পাশাপাশি ইতোমধ্যে যে সব জমির ধান পেকে এসেছে তা দ্রুত ঘরে তোলার পরামর্শও দিয়েছে ডিএই।
তবে ইতোমধ্যে যেসব জমির বোরো কর্তন হয়েছে, সেখানে উৎপাদন নিয়ে আশান্বিত কৃষকগন। দক্ষিণাঞ্চলে এবার ‘উচ্চ ফলনশীল’ বোরো ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৪.০১ টন, ‘হাইব্রীড’ প্রায় ৫ টন এবং মাত্র যে প্রায় ৫ হাজার হেক্টরে স্থানীয় সনাতন জাতের ধান আবাদ হয়েছে, তার গড় ফলন পাওয়া যাচ্ছে হেক্টরে ২ টনেরও কম। বোরো ধানের এ গড় ফলনে লক্ষ্য পুরনে আশাবাদী হলেও আসন্ন দূর্যোগ নিয়ে শংকিত দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক সহ ডিএই’র দায়িত্বশীলগনও।
এমনকি সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির মত সব প্রতিবন্ধকতার পরেও ১০ লক্ষাধিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে সমাপ্ত প্রায় রবি মৌসুমে ১৭ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদন লক্ষ্য অতিক্রমের ফলে উদ্বৃত্বের পরিমান আরো বাড়তে পারে। ইতোপূর্বে পৌষের শুরু থেকে তাপমাত্রা অব্যাহত ভাবে স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাবার সাথে ঘন কুয়াশায় ‘কোল্ড ইনজুরী’তে ক্ষতির সম্মুখিন হয় কিছু বীজতলা। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরনেও দমে থাকেননি কৃষকগন। ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, এবার শীতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাবার সাথে আগেভাগে শীত বিদায় সহ মাঘের মধ্যভাগ থেকে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাওয়ায় পরিবেশগত কিছু সমস্যা তৈরী হলেও সব প্রতিকুলতা অতিক্রম করেই দক্ষিণের বোরো ধানের জমিতে কৃষিযোদ্ধাদের হাঁসি ফুটে উঠছে। কিন্তু ধানের দাম নিয়ে খুশি নন কৃষক।
এবার দক্ষিনাঞ্চলে হাইব্রীড ও উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের আবাদও বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার অনেক বেশী। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই আশাবাদী ছিল ডিএই। সমাপ্ত প্রায় বোরো মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদকৃত ৩ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ হেক্টরে হাইব্রীড জাতের ধান আবাদ হয়েছে। এর বাইরে উচ্চ ফলনশীল জাতের আবাদের পরিমান ২ লাখ ১৭ হাজার হেক্টরেরও বেশী। আর স্থানীয় সনাতন জাতের বোরো আবাদের পরিমান ৪ হাজার ৭৬৬ হেক্টরে নেমে এসেছে। হাইব্রীড জাতের ধানের আবাদ বৃদ্ধিকে কৃষিবীদগন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিনাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক বলেও মনে করছেন।
এবার রবি মৌসুমে দেশে ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৬০ হেক্টরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের ফলে ২ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদনে দৃঢ় আশাবাদী ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল সহ কৃষি মন্ত্রনালয়। এরমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় বোরো থেকে প্রায় ১৭ লাখ টন চাল পাবার লক্ষ্য স্থির করে ৩ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য স্থির করেছিল মন্ত্রনালয়। বিগত খরিপ-২ মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে ৮ লাখ ৫৭ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ লক্ষ্য অর্জিত হয়। ফলে এ অঞ্চলে প্রায় ২০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল উৎপাদন লক্ষমাত্রাও অতিক্রম করেছে বলে মনে করছে ডিএই। বিগত খরিপ-১ মৌসুমেও এ অঞ্চলে আবাদকৃত আউশ থেকে প্রায় ৬ লাখ টন চাল পাওয়া গেছে।
তবে প্রতি বছরই দক্ষিণাঞ্চলে খরিপ-১, খরিপ-২ ও রবি মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশ’,‘অশণি’ ও ‘সিত্রাং’এর মত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেই ধান সহ সব ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে ক্লান্ত কৃষি যোদ্ধারা। একের এপর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগ কৃষকদের ক্ষতির সাথে দুশ্চিন্তাকে বৃদ্ধি করে চললেও বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় এবার ৩টি মৌসুমে দানাদার খাদ্য ফসল উৎপাদন ৫০ লাখ টন অতিক্রমের ব্যপারেও আশাবাদী কৃষি মন্ত্রনালয়। এবার শীত মৌসুম শুরুর আগেই তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের নিচে নামার পরে আগাম মৃদু থেকে মাঝারী তাপ প্রবাহের ফলে বোরো ধান আগে পাকতে শুরু করেছে।
গত দুদিন বরিশাল,পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা সরেজমিনে ঘুরে কৃষি যোদ্ধাদের অবিরাম ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেছে। তবে বড় ধরনের কোন কালবৈশাখী সহ ভারী বর্ষণ বিপর্যয় ডেকে না আনলেও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের হাত ধরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোচা’র গতি প্রকৃতি নিয়ে শংকিত দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকুলের কৃষি যোদ্ধাগন। বিগত প্রায় ৩টি বছরের করোনা মহামারী সংকটে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কৃষি ও কৃষকই মূখ্য ভুমিকা পালন করলেও এখনো যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগই কৃষি সহ খাদ্য নিরাপত্তায় বড় হুমকি। আর কৃষিনির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিকে সচল রাখতে কৃষির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির জন্য ইতোমধ্যে যথেষ্ট নাজুক পরিস্থিতি তৈরী করেছে। ডিজেল ও সারের মূল্য বৃদ্ধি বোরো ধানে উৎপাদন ব্যয় মন প্রতি প্রায় দেড়শ টাকা বেড়েছে বলে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকগন দাবী করলেও সে তুলনায় ধানের দাম বাড়েনি বলে জানিয়েছেন। যুগের পর যুগ ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি, কৃষক ও কৃষি অর্থনতিকে টিকে থাকার সংগ্রামে কৃষি ব্যবস্থাপনাকে আরো আধুনিক এবং যুগোপযোগী করতে গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থনীতিবীদগন। এক্ষেত্রে ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর’কে কৃষকদের সাথে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তরেরও তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদগন।