3:36 pm , May 6, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নানা অব্যবস্থা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ৫টি ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীরা ক্রমাগত মানবিক বিপর্যয়ের কবলে। আলো-বাতাশহীন দুর্গন্ধময় দমবন্ধ করা পরিবেশে রোগীদের প্রাণ প্রতিনিয়ত ওষ্ঠাগত। হাসপাতালটির মূল ভবনের দক্ষিন-পূর্ব কোনে বছর চারেক আগে নির্মিত ৫তলা ভবনটিতে ২০২০ সালের মার্চে করোনা ওয়ার্ড এবং গত ডিসেম্বরের শেষভাগে মেডিসিন ওয়ার্ডের ৪টি ইউনিট স্থানান্তরের পরে তা কোন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে নেই বলে দাবী রোগী এবং একাধিক সিনিয়র ও জুনিয়র চিকিৎসকদের। ফলে এ ভবনে স্থানান্তরিত মেডিসিন বিভাগের ৪টি ইউনিট সহ সদ্য চালু করা আরো একটি বিশেষায়িত মেডিসিন ইউনিটে চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসহীন পরিবেশে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ সরকারী চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানটির মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগীসহ চিকিৎসা কর্মীদের দুর্ভোগ এখন চরমে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নব নির্মিত ভবনটিকে চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানের উপযোগী করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিলেও গণপূর্ত বিভাগ বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ বলে অভিযোগ হাসপাতাল পরিচালক সহ চিকিৎসকদের। গত প্রায় ৫ মাস ধরে চরম অব্যবস্থা ও অমানবিক পরিবেশে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ সরকারী চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানটির মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসার নামে রোগীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও পরিস্থিতি উন্নয়নে কোন অগ্রগতি নেই।
গত ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হাসপাতালের মূল ভবন থেকে মেডিসিন ওয়ার্ডের ৪টি ইউনিটি নব নির্মিত ভবনে স্থানান্তর করা হয়। তখন বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্রÑছাত্রীসহ হাসপাতাল কর্মীদের তরফ থেকে ভিন্নমত প্রকাশ করা হলেও তা আমলে না নিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ড স্থানান্তরের পরে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালটির পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, গণপূর্ত বিভাগকে ভবনটির বিভিন্ন স্থানে আলো বাতাসের সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে আরো ২৮টি জানালা ও সহ শৌচাগার করে দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তেমন সাড়া মিলছে না।
এ ব্যাপার গণপূর্তের মেডিকেল সাব-ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জানান, যে ভবনটিতে মেডিসিন ওয়ার্ড স্থাপন করা হয়েছে, মূল নকশায় তার নিচতলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত কোন রোগী থাকার কথা নয়। মূলত ৬ষ্ঠ তলা থেকে দশম তলায় হাসপাতালের ইনডোর থাকার কথা। যা এখনো নির্মিত হয়নি। তার পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত কয়েকটি শৌচাগার করে দেয়া হয়েছে। বিধি বহির্ভূতভাবে ভবনটির করিডোরেও রোগী থাকছে, সেখানেও ফ্যান লাগানো হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্তের দায়িত্বশীল একটি সূত্রের মতে,‘ভবনটির নকশা ও নির্মান পরিকল্পনাকে আমলে না নিয়ে সেখানে মেডিসিন ওয়ার্ডের পুরনো ৪টি সহ নতুন আরেকটি ইউনিট স্থানান্তরের ফলে রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি বেড়েছে। মূলত নতুন এ ভবনটিকে ৫শ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে নির্মানের পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু প্রথম তলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত ইনডোর হিসেবে নির্মিত হয়নি। সেখানে এখন প্রতিনিয়ত ৮শ থেকে প্রায় ১২শ রোগী রাখলে কোন সুস্থ্য পরিবেশ থাকার কথা নয়’। নির্মান পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০তলা ভবনটির নিচ তলায় বহির্বিভাগ, দোতালায় প্রশাসনিক ব্লক ও ব্যাংক এবং ৩য় তলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটার স্থাপনের কথা ছিলো। সে নকশাতেই ভবনটি নির্মিত হয়েছে। আর ৬ষ্ঠ তলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ওয়ার্ড স্থাপনের কথা।
কিন্তু ১০ বছর ধরে ৫তলা ভবন নির্মানের পরে মূল পরিকল্পনাকে এড়িয়ে সেখানে মেডিসিন ওয়ার্ডের ৫টি ইউনিট চালু করায় সুচিকিৎসার নামে চিকিৎসাধীন রোগীদের জীবন মরন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বলেও অভিযোগ চিকিৎসক, রোগী এবং স্বজনদের।
পাশাপাশি ভবনটির নির্মান কাজ মানসম্মত হয়নি বলেও অভিযোগ হাসপাতালের দায়িত্বশীল সূত্রের। করোনা মহামারীর শুরুতে তড়িঘরি করে ভবনটির কাজ শেষ করে সেখানেই ‘কোভিড-১৯ ওয়ার্ড’ চালু করায় নির্মান প্রতিষ্ঠানকে আর কোন জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মেডিসিন ওয়ার্ডের ৪টি ইউনিট স্থানান্তরের পরে সেখানে আরো একটি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসাধীন রোগীদের সিমাহীন দুর্ভোগ ছাড়াও চিকিৎসক ও নার্স সহ সব ধরনের চিকিৎসা কর্মীদের ভোগান্তি এখন সব বর্ণনার বাইরে।
এক হাজার শয্যার হাসপাতালে প্রতিনিয়ত দেড় হাজারেরও বেশী রোগী চিকিৎসাধীন থাকছে। এমনকি হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডের ৫টি ইউনিটে অনুমোদিত বেড সংখ্যা প্রায় ৫শ হলেও প্রতিদিন চিকিৎসাধীন থাকছে এক হাজারেরও বেশী। কিন্তু অপরিসর ও আলো বাতাসহীন ময়লা আবর্জনা আর দুর্গন্ধময় এ নতুন ভবনটির ২য় তলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত বেডের চেয়ে এখন মেঝেতেই রোগীর সংখ্যা বেশী। আলো বাতাস চলাচলের অপ্রতুল সুবিধার ভবনটিকে হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত নয় বলেও দাবী চিকিৎসকদের। এমনকি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে পাঁচতলা ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ড সমূহে অনেকটাই ভুতূড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে।
মেডিসিন বিভাগের পেয়িং বেড এবং পেয়িং কেবিন সহ প্যাথলজি ও এক্স-রে এখনো হাসপাতালের মূল ভবনে রয়ে গেছে। ফলে মেডিসিন ওয়ার্ডের সব রোগীদের দেখভাল করা সহ চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের দুটি ভবনে ছুটতে হচ্ছে। এমনকি মূল ভবনে পেয়িং কেবিন ও পেয়িং বেডে চিকিৎসাধীন মুমূর্ষু রোগীরা অনেক জরুরী প্রয়োজনে যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ উঠছে। নতুন ভবনের মেডিসিন ইউনিটের রোগীদের পথ্য আসছে ৩শ মিটার দূরের মূল ভবনের ৫ম তলা থেকে। ফলে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি আর ধুলোÑবালুর রাস্তায় প্রতিদিন তিন বেলা ট্রলিতে ছোট-বড় হাড়ি চাপিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডের রোগীদের পথ্য পরিবেশন করতে গিয়েও ক্লান্ত হাসপাতাল কর্মীরা। খাবারের গুনগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নতুন এ মেডিসিন ওয়ার্ডে মেডিকেল কলেজের বিপুল সংখ্যক ছাত্রÑছাত্রীর ক্লাস করার মত পরিবেশ না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। হতাশ ছাত্র-ছাত্রীরা বিষয়টি কলেজ অধ্যক্ষ ও হাসপাতাল পরিচালককে অবহিত করেও কোন সুফল না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ।
এ ব্যাপারে হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের সদ্য বিদায়ী প্রধান ডাঃ আনোয়ার হেসেন বাবলু’র সাথে আলাপ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলামের সাথে সেল ফোনে কথা বলা হলে তিনি মেডিসিন ইউনিটের কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা সব সমস্যা অতিক্রমের চেষ্টা করছি। ভনটির ৬ষ্ঠ থেকে দশম তলা পর্যন্ত নির্মানের লক্ষে মন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন হয়েছে বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি গণপূর্ত বিভাগকে ভবনটিতে আরো ২৮টি জানালা নির্মান করে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। তবে সেখান থেকে কাঙ্খিত সাড়া মিলছে না বলেও স্বীকার করেন পরিচালক।
মূল পরিকল্পনায় প্রথম থেকে ৫ তলা পর্যন্ত ওয়ার্ড স্থাপনের কথা ছিলোনা বলে স্বীকার করে হাসপাতালের মূল ভবনে রোগীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে নতুন ভবনে মেডিসিন ওয়ার্ড স্থানান্তর করতে হয়েছে বলেও জানান পরিচালক।