3:56 pm , March 14, 2023

সাইদ মেমন ॥ সারাদেশে আট মাসের জাটকা শিকারে নিষিদ্ধ সময় চলছে। একই সময়ে চলছে বরিশালের তিন নদীর প্রায় শত কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অভয়াশ্রমে মাছ শিকারের দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা। এই নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের দেয়া হচ্ছে না কোনরকম প্রনোদনা। জাটকা শিকার নিষিদ্ধের ৮ মাসে মাত্র চার মাসের প্রনোদনার চাল দেয়া হচ্ছে জেলেদের। সেই চাল সহায়তাও পাচ্ছেন না সিংহভাগ জেলেরা। যারা পাচ্ছেন, তারাও সরকারের দেয়া নির্ধারিত পরিমান চাল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগ পরিমানে কম অনেক কম চাল দেয়া হয়। যে কারনে নদীতে মাছ শিকারে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন জেলেদের অনেকে। কোন না কোন উপায়ে জেলেরা জাটকাসহ অভয়াশ্রমে মাছ শিকার করছে। নিষিদ্ধ সময়ে মাছ শিকারে গিয়ে ধরা পড়ে শাস্তিও ভোগ করছেন তারা। তবে সফলতাও রয়েছে জানিয়ে হিজলা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এমএম পারভেজ বলেন, আমাদের চেষ্টা শতভাগ জেলে সহায়তার আওতায় আসুক। কিন্তু সবকিছু তো চাইলেই হবে না। সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি বলেন, শিকার নিষিদ্ধ সময় ছাড়াও মৎস্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ সময়ে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বকনা বাচুর দেয়াসহ বিভিন্ন সময়ে সহায়তা দেয়া হয়। জেলেদের নিয়ে সচেতনত করার সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। মাছের উৎপাদন বাড়লে জেলেদের লাভ। সেই বিষয়টি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ সময়ে জাল ফেলা ও মাছ শিকার বন্ধে সফল হয়েছেন জানিয়ে মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এ কারনেই তো বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
এমএম পারভেজ বলেন, হিজলা উপজেলায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ২০ হাজার। নিবন্ধের বাইরে রয়েছেন আনুমানিক অন্তত হাজার তিনেক। কিন্তু জাটকা শিকার নিষিদ্ধ সময়ের জন্য চাল সহায়তা পাচ্ছেন ১২ হাজার জেলে।
তিনি জানান, বরিশালের গজারিয়া, কালাবদর ও মেঘনা নদীর ৮২ কিলোমিটার এলাকা অভয়াশ্রম। বর্তমানে সেখানে সকল ধরনের মাছ শিকার বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন বলেন, তিনটি কারনে জেলেদের মাছ শিকার থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। এগুলো হলো-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকা, দারিদ্রতা ও আড়তদারদের প্রলোভন বা চাপ।
তিনি বলেন, রাতে নদীতে কোষ্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ নদীতে অভিযান করতে চায় না। তাই রাতের বেলায় জেলেরা মাছ শিকার করে।
কামাল হোসেন বলেন, বর্তমানে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় ২৪ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৯২৫ জেলেকে চাল দেয়া হয়েছে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির হিজলা উপজেলা শাখার সভাপতি মো. জাকির হোসেন বলেন, মেঘনা নদীতে অভিযান চলে (শিকার নিষিদ্ধ সময়) সেটা দেখলে বোঝা যাবে না। নদীতে জেলেরা মাছ ধরছে। তাদের কোনভাবে মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। এর কারন হিসেবে বলেন, বর্তমানে নদীতে প্রচুর মাছ রয়েছে। এক বস্তা চাল ও একটি বাছুরের চেয়ে একবার জাল ফেললে ৫০ থেকে এক লাখ টাকার মাছ ধরা পড়ে। তাই জেলেরা নদীতে মাছ ধরে। মাছ ধরতে বাধা দিলে প্রশাসনের সাথেও ঝামেলা করে। এছাড়াও কিছু অসাধু কর্মকর্তা রয়েছে। তাদের ইন্ধনে জেলেরা মাছ ধরে। স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বর ও নেতারা জেলেদের মাছ ধরতে নিষেধ করতে পারে। কিন্তু তারা করবে না। কিছু কিছু চেয়ারম্যান, মেম্বর ও নেতারা জেলেদের মাছ ধরতে উৎসাহ দেয়।
মাছ শিকার নিষিদ্ধ এলাকার বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হবিনগর এলাকায় গত সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নদীজুড়ে মাছ শিকার চলছে। মাঝ নদীতেসহ তীরেও ঘের জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে জেলেরা।
তাদের মাছ শিকার থেকে বিরত রাখতে কোন সংস্থা কখনও কোন পদক্ষেপ নেয় না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ট্রলার চালক বাদল। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে কোষ্টগার্ডের টহল দেখা যায়। ওই সময় জেলেরা নদীতে থাকে না।
মাছ শিকাররত শায়েস্তাবাদ উপজেলার কামাড়পাড়ার জেলে দুলাল বলেন, তিনি জাটকা শিকার করেন না। তিনি ছোট মাছ শিকার করেন। তাই তিনি চাল পান না। তার দাবি বড় জাল দিয়ে শিকার করা জেলেরা চালও পায়, আবার মাছও ধরে। কেউ কিছু বলে না।
জেলে করিম বলেন, গত এক যুগ ধরে নদীতে মাছ শিকার করেন। কিন্তু কোন সহায়তা পাননি। বাকেরগঞ্জের লক্ষ্মীবর্ধন গ্রামের জেলে জাহাঙ্গীর খান অভিযোগ করেন, তাদের ৪০ কেজি করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে ৩০-৩২ কেজি করে। বাকি চাল চেয়ারম্যান মেম্বররা কম দেয়। মাছ শিকার আট মাস হলেও চাল দেয় চার মাস। তাও কম দেয়, তাই জেলেরা মাছ শিকারে যায় বলে জানান জাহাঙ্গীর। বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য দপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. নাসিরউদ্দিন বলেন, অভয়াশ্রমে মাছ শিকার নিষিদ্ধ সময়ে কোন সহায়তা দেয়া হয় না। নভেম্বর থেকে জুন মাস নদীতে জাটকা ও মার্চ এপ্রিল দুই মাস অভয়াশ্রমে সকল ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ। এর জন্য ৪০ কেজি করে চার মাস জেলেদের চাল দেয়া হয়। এ সহায়তা সকল জেলে পায় না। সহকারী পরিচালক বলেন, জাটকা সংরক্ষন সহায়তার চাল যারা পায় না তাদের অভয়াশ্রমে শিকার নিষিদ্ধ সময়ে সহায়তা দেয়া উচিত। বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি জানান, বরিশাল বিভাগে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪ লাখ ১ হাজার ৮৮ জন। এর মধ্যে জাটকা ও ইলিশ শিকারের জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৩ হাজার ১১৯ জন। তাদের মধ্যে চাল সহায়তা পায় ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৭ জন। তাদের জন্য বরাদ্ধকৃত চালের পরিমান ৩৬ হাজার ৮২৯. ৯২ মেট্রিক টন।