3:12 pm , March 13, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ অনেকটা অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধে নামার মতো অবস্থা বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার বেইজ কার্যক্রমের। মান্ধাতা আমলের কয়েকটি ড্রেজার ছাড়া আধুনিক কোনো সরঞ্জামই নেই তাদের। বরিশালসহ দেশের নদীবাহিত ১১টি জেলায় ড্রেজার বেইজ অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণ হলেও এসব ভবন শুধু খরচের বোঝা বাড়িয়েছে বলে দাবী নদী গবেষকদের। তবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলছে আমাদের ড্রেজার পর্যাপ্ত রয়েছে, আরো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আসার প্রক্রিয়া চলছে।
নদী খননে গুরুত্ব আরোপ করে বাংলাদেশ সরকারেরর নৌ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে বরিশালসহ সারাদেশে প্রায় তিনশ কোটি টাকা খরচ করে ১১টি ড্রেজার বেইজ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ভবনগুলো থেকেই ওই এলাকার নদীপথে নৌযান চলাচল উপযোগী রাখার সার্বিক কাজ পরিচালিত হবে। এছাড়াও ড্রেজারের যান্ত্রিক ত্রুটি বা নদী খননকালে সৃষ্ট সংকট বিষয়েরও যাবতীয় পদক্ষেপ গৃহীত হবে। প্রতিটি ভবনে ড্রেজিং সিভিল ও মেকানিক্যালের দুটি অফিস, ডরমেটরি, ডিজিটাল রিভার মনিটরিং এর নিয়ন্ত্রন কক্ষ, কনফারেন্স রুম ইত্যাদি ছাড়াও বরিশালের ক্ষেত্রে নদী পাড়ে থাকবে ৮টি টাগসহ ড্রেজার, টার্মিনাল, গ্যাংওয়ে, অত্যাধুনিক স্টোরেজ, পাইপ বোর্ড ও ক্রেন।
সরেজমিনে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও নির্ভিক ক্রেন দুটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ড্রেজার বেইজ ঘাট থাকলেও ঘাটে কোনো ড্রেজার বা ক্রেন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এখানেই মুক্তিযোদ্ধা পার্কের প্রবেশ পথে হাতের বাম পাশে দৃষ্টিনন্দন ভবনটি ড্রেজার বেইজ ভবন। এটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক কৌতূহল এখানে। বিশেষ করে রাতের বেলা আধো আলো আধারীতে অনেকটা ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয় এই ভবনটিকে। অনেকেই কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করেন- কি এটা, কি কাজ এই ভবনের? উঠানে বা আঙিনায় ঢেকে রাখা লম্বাটে ওটাকি? আলো নেই কেন? রাতে কি এখানে কেউ থাকে না? এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ১২ ও ১৩ মার্চ রবিবার ও সোমবার চারতলা ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, প্রবেশ পথেই ছোট সাইনবোর্ড এবং ভবনের উপরে বড় সাইনবোর্ডে লেখা বরিশাল ড্রেজার বেইজ বিআইডব্লিউটিএ। প্রায় ৭ একর জমিতে চমৎকার দৃষ্টিকাড়া এই ভবনটির সম্মুখে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরাল। তবে কাপড় ও সালা দিয়ে আপাততঃ ঢাকা আছে পুরোটাই। ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে অনুমান করা যায়- এটি খুব সম্ভব অসমাপ্ত ডায়েরির প্রচ্ছদ আদলের নির্মাণশৈলী।
চারতলা ভবনটির প্রথম তলায় কোনো লোক সমাগম নেই। পুরোটাই স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে তা পরিষ্কার বোঝা যায় কয়েকটি কক্ষে বিভিন্ন মালামালের স্তুপ দেখে। ভবনে ওঠার জন্য তিনটি সিঁড়ি। দক্ষিণ, মাঝামাঝি ও উত্তর-পূর্ব কর্ণার। অনেকটাই ইউ আকৃতির এই ভবনটি নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একটু কোনাচে আঙ্গিকে। দ্বিতীয় তলায় ওঠে দেখা গেল দক্ষিণ পাশের প্রায় সব কক্ষে তালা ঝুলছে। এদিকটায় লোক চলাচল খুব একটা নেই, তাই ময়লা ও ধুলোর আস্তর জমেছে। এখানের উত্তর পূর্বাংশে বেশ কয়েকজন উপসহকারী ও সহকারী প্রকৌশলীর নেমপ্লেটে তাদের নাম আছে, তারা নেই কেউ। একটি কক্ষে লোকজনের আনাগোনা দেখে অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে আলাপ হলো ড্রেজার বেইজ যান্ত্রিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শরিফুল ইসলামের সাথে। তিনি জানালেন, সবাই লাঞ্চে গিয়েছেন, চলে আসবেন হয়তো। তিনি আরো জানান, এখানে তারা ৭ জন কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সহকারী কাজ করছেন। এই মুহুর্তে বরিশাল বিভাগে মোট ১৪ টি ড্রেজার নদী খননের কাজে নিয়োজিত আছে। আরো অনেকগুলো ড্রেজার ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রসেসিংএ আছে। তবে কীর্তনখোলা নদীর দূষণ ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শরিফুল ইসলাম।
তৃতীয় তলার অর্ধেক নিয়ে মেকানিক্যাল মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং (এমএমই) অফিস। এখানে নৌ প্রকৌশল বিভাগের অফিস সহকারী আব্দুস সালাম জানালেন, তারা সর্বমোট ৩২ জন এখানে আছেন। যদিও দেখা পাওয়া গেছে মাত্র চারজনের ।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক আব্দুর রাজ্জাক জানান, ড্রেজার বেইজ ভবনের দুটো কাজ। নদী খনন ও জাহাজ মেরামত। এই সংশ্লিষ্ট বিভাগের যাবতীয় কাজকর্ম এই ভবন থেকে পরিচালিত হবে। তবে এখনো পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে কি হয়নি তা আমি বলতে পারবো না, মেরিন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বলতে পারবেন হয়তো।
বরিশালের ১৩৩টি ছোট বড় নদী সারা বছর ধরে দ্রুত খননের আওতায় এনে নাব্য সচল রাখার জন্য এই ড্রেজার বেইজ ভবন নির্মাণ ও কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রায় একবছর আগে। তারপরও নাব্যতা সংকটে কাটছে না এ অঞ্চলে। অন্যদিকে কীর্তনখোলা নদীর অবস্থা ক্রমশ ঢাকার বুড়িগঙ্গার মতো হবার আশঙ্কা নদী শাসন কর্তৃপক্ষেরই। বরিশালের সুশীল সমাজ ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতা কাজী মিজানুর রহমান, রফিকুল আলম, এনায়েত হোসেন শিবলু প্রায়শই এনিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বরিশাল অঞ্চলের নাব্যতা রক্ষায় প্রায় ১৪৫০ কিলোমিটার নৌ পথের অন্তত ৩৫টি স্থানে প্রতি বছর কমপক্ষে ২১ লাখ থেকে ২৫ লাখ ঘনফুট নদী খনন কাজ করতে হয়। এটি করতে গিয়ে প্রতি বছরই চিঠি চালাচালিতে ব্যয় হয় দীর্ঘ সময়। দূর-দূরান্ত থেকে ড্রেজার এনে খনন কাজ করতে ব্যয় হয় অতিরিক্ত অর্থ। এই সংকট দূর করতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপির চেষ্টায় বরিশালে ড্রেজার বেইজ ভবন নির্মাণ ও কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালে। এতে করে সারা বছর ড্রেজিং কাজের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বজায় থাকবে বলে মনে করেছিলেন নৌ দপ্তরের কর্তারা। কিন্তু গত একবছরে বরিশালে ড্রেজার বেইজ কার্যক্রমের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি বলে অভিযোগ লঞ্চ চালকদের। তারা বলেন, কীর্তনখোলা নদীর অবস্থা দিনকে দিন ঢাকার বুড়িগঙ্গার মতো হচ্ছে। ঘাট এলাকায় কি অবস্থা তা কিছুদিন আগে সব মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। ড্রেজার মেশিন বন্ধ হয়ে গেছিলো। অথচ ওয়াটার ক্যামেরা ব্যবহার করে আগে ময়লা সরিয়ে নিলে এটা হতোনা। নদী কাটার যন্ত্রপাতিতে আধুনিকতা আনার দাবি করেছেন বরিশালের প্রায় সব নৌযানগুলোর চালকরা। সুরভী, সুন্দরবন, পারাবত পাইলটদের সাথে এ নিয়ে কথা বললে তারা জানান, সরকারি ড্রেজারের কাটিং লাংগলের ব্যাস বড় করতে হবে। এট যাতে নদীর গভীরতার অন্তত ২০ মিটার পর্যন্ত কাটতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে, তাহলে ড্রেজিংকে স্থায়ী করবে।
যাত্রিবাহী আধুনিক জাহাজের চলন গভীরতা অনুযায়ী ড্রেজিং কাজ করার দাবি তোলেন বরিশালের লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু।
যার কিছুই এখনো নেই বলে স্বীকার করেন নৌ বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর সরেজমিন অনুসন্ধানে লোকবল সংকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে ড্রেজার বেইজ ভবনে কর্মকর্তাদের উপস্থিতি দেখে। যেখানে লোকবল থাকার কথা প্রায় ছয় শতাধিকসেখানে কর্মচারী ও শ্রমিক মিলিয়ে ৫০ জনও নেই ভবনে। তবে নদীতে ভাসমান ড্রেজার ও মেরিন ইঞ্জিনের কাজে জড়িত আছেন প্রায় আড়াই শত শ্রমিক। যা প্রয়োজনের একভাগ মাত্র। ভবনের চতুর্থ তলা পুরোটাই কর্মকর্তাদের ডরমেটরি। এখানে লোকজনের আনাগোনা স্পষ্ট হয় পরিচ্ছন্নতায় নজর দিলেই। যা নীচতলাগুলোতে দেখা যায়নি। এখানে তিনটি কক্ষের দরজায় একাধিক জুতো দেখে বোঝা যাচ্ছে কর্মকর্তাদের অন্তত তিনজন বা অতিথি রয়েছেন এখানে। মাঝখানের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই চোখে পড়ে নৌ প্রতিমন্ত্রী ও সিটি মেয়রের নামাঙ্কিত একটি উদ্বোধন ফলক।
মেরিন ওয়ার্কশপ চত্ত্বরে নবনির্মিত এই ড্রেজার বেইজ ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি। ওই সময়ের সংবাদ ঘেঁটে জানা যায়, তিনি ছয়তলা ড্রেজার বেইজ ভবন এবং চারতলা কর্মচারী ডরমেটরি উদ্বোধন করেছেন। এসময় প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সহ ক্রমবর্ধমান ড্রেজিং চাহিদা মেটাতে বরিশালসহ সারাদেশে ১১টি ড্রেজার বেইজ ভবন স্থাপন করা হয়েছে। যার মধ্যে বরিশালে ৬ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন এবং ৪ তলা বিশিষ্ট একটি ডরমেটরি নির্মাণ করা হয়েছে। বরিশাল ড্রেজার বেইজের আওতায় ২০টি ড্রেজার সহ সহায়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি থাকবে। এই প্রকল্পে মোট ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এখান থেকেই বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনা এলাকার নৌপথ খনন এবং তদারকি করা হবে।
কিন্তু মেরিন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুনুর রশীদ বললেন, সাড়ে ছয় একর জমিতে চারতলা ড্রেজার বেইজ ভবন এবং দোতলা ডরমেটরি নির্মাণসহ জাতির জনকের ম্যুরাল নির্মাণ হয়েছে। ম্যুরালের সব কাজ শেষ। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। লোকবল সংকটের কারণে ভবনের পুরোপুরি কাজ এখনো শুরু হয়নি বলে জানান তিনি।
এদিকে বরিশালের নদী গবেষক রফিকুল আলম বলেন, নদী রক্ষার জন্য বরিশালে ড্রেজার বেইজ ভবন হয়েছে প্রায় এক বছর। কিন্তু এই একবছরে তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। তাদের সমন্বিত কোনো উদ্যোগও নেই। আবার লঞ্চ মালিকদের কোন বিষয়ে তারা জানতে চান না। নিজেদের খেয়ালখুশি মতো তারা নদীতে খনন কাজ চালান।
তিনি আরো বলেন, ড্রেজার বেইজ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে হলে তাদের সমন্বিত উদ্যোগে জিপিএস ট্রাকিং এর মাধ্যমে নদী খনন করতে হবে। নদী থেকে উঠে আসা বর্জ্য – আবর্জনা আবার নদীতেই না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে তা সরিয়ে নিতে হবে।
তবে ড্রেজার বেইজ এর অতিরিক্ত পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, সারাদেশে ৪৫টি ড্রেজার রয়েছে। আরো প্রায় ৮০টি অত্যাধুনিক ড্রেজার ও ক্রেন আনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে আমাদের খুবই সমস্যা হচ্ছে।