দক্ষিণাঞ্চলে ২৭ লক্ষাধিক টন তরমুজ উৎপাদন দক্ষিণাঞ্চলে ২৭ লক্ষাধিক টন তরমুজ উৎপাদন - ajkerparibartan.com
দক্ষিণাঞ্চলে ২৭ লক্ষাধিক টন তরমুজ উৎপাদন

3:37 pm , March 12, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ এবারো দেশে আবাদ ও উৎপাদনের ৭০ ভাগেরও বেশী তরমুজের  যোগান দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। তবে মাঠ পর্যায়ে ভাল দাম না পেয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে না কৃষকদের। গত বছর রবি মৌসুমে দেশে প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে ২৬ লাখ টনের মত তরমুজ উৎপাদন হলেও দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলার ৩৭ হাজার হেক্টরে উৎপাদন ছিল প্রায় ১৭ লাখ টন। কিন্তু এবার পরিস্থিতির আশাতীত উন্নতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র মতে, এবার বরিশাল,পটুয়াখালী,ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠী জেলার উঁচু ও উপকূলীয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপসহ নদী তীরবর্তি প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। নদ-নদীবহুল দক্ষিনাঞ্চলের নোনাপানি মুক্ত চরাঞ্চলের পলি মাটিতেও তরমুজের ভাল আবাদ ও ফলন হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় পরিপক্ক সুমিষ্ট তরমুজ বাজারে আসতে শুরু করেছে।
ডিএই দক্ষিণাঞ্চলে এবার হেক্টর প্রতি প্রায় ৪২ টন হিসেবে ২৭ লাখ টনের মত তরমুজের উৎপাদন আশা করছে। যা গত বছর সারাদেশে সর্বমোট উৎপাদনেরও বেশী এবং দক্ষিনাঞ্চলে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১০ লাখ টন বাড়তি বলে জানা গেছে।
চীনা ভেষজবীদদের মতে, তরমুজের রস রক্তচাপ স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে সহায়তা করে। পাকা তরমুজের রসালো শাস স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হবার পাশাপাশি তা অত্যান্ত তৃপ্তিদায়ক ও তৃষ্ণা নিবারক। উন্নত বিশ্বে তরমুজ দিয়ে নানা ধরণের সরবত, জ্যাম, সিরাপ, গুড় ছাড়াও এ্যালকহল পর্যন্ত  তৈরী হচ্ছে। এমনকি সাইট্রেন শ্রেণীর তরমুজ দিয়ে জেলিও তৈরী হচ্ছে বলে জানা গেছে। কৃষি ও পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে তরমুজে যথেষ্ট পরিমান ভিটামিন-এ, রিবোফ্লাভিন, থায়ামিন ও পেপটিন বিদ্যমান রয়েছে।
তবে বাড়তি আবাদ ও উৎপাদন এবারো দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারছেনা। কৃষকরা মাঠে গড়ে প্রতিটি তরমুজ দেড়শ টাকায় বিক্রী করতে না পারলেও বাজারে আসার পরে তা বিক্রী হচ্ছে ৩শ থেকে ৫শ টাকার ওপরে। এমনকি বরিশালের বাজারে এবারো ৫০ টাকা কেজি দরে তরমুজ বিক্রী হচ্ছে। গত বছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ ‘অশনি’র প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতে দক্ষিনাঞ্চলে কয়েক লক্ষ লক্ষ টন তরমুজ বিনষ্ট হয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েন লক্ষাধিক চাষি। গত মৌসুমে রোজা শুরুর আগেই বাজারে তরমুজ আসতে শুরু করলেও পাইকারদের নানা অজুহাতে চাষিরা ভাল দাম পায়নি। তবে ভোক্তাদের বাজার থেকে অনেক বেশী দামেই তা কিনতে হয়েছে। উপরন্তু ঈদকে সামনে রেখে চাহিদা কমে যাওয়ায় চাষীরা দর পতনের আশংকায় রোজার শেষ দিকে মাঠ থেকে তরমুজ উত্তোলন ও বিক্রী করেনি।
কিন্তু ঈদের পর পরই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে ভর করে উপকূলভাগ জুড়ে প্রবল ভারি বর্ষনে বরিশাল ছাড়াও পটুয়াখালী,ভোলা, বরগুনা ও পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া এলাকার বিপুল পরিমান তরমুজ মাঠেই পচে বিনষ্ট হয়।
চলতি রবি মৌসুমে এখনো বড় ধরনের প্রকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলেও গত তিন মাস ধরে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। এমনকি চলতি বছরের প্রথম দুমাসই পুরো দক্ষিণাঞ্চল বৃষ্টি শূন্য। ফলে তরমুজ ও বোরা ধানসহ এ অঞ্চলের বেশীরভাগ অর্থকরী ফসল আবাদ ও উৎপাদন ব্যাহত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা। তরমুজের বীজ রোপন থেকে উৎপাদন পর্যন্ত কয়েক দফায় সেচ দিতে হয় বিধায় শীত বিদায়ের  পরে হালকা বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হলেও এবার তা এখনো অনুপস্থিত।
মুলত ৫.৫ থেকে ৭.০ পিএইচ মাত্রার জমি সুমিষ্ট তরমুজ আবাদের জন্য উপযোগী হলেও কোন অবস্থাতেই তা অতিরিক্ত লবনাক্ততা সহ্য করতে পারেনা। পাশাপাশি খরা প্রতিরোধক ফসল তরমুজ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও লাগাতার বৃষ্টির অভাবে এর উৎপাদন ব্যাহত হবারও আশংকা রয়েছে। বর্ষজীবী, দিবস দৈর্ঘ্য নিরপেক্ষ ও লতানো প্রকৃতির কুমড়া পরিবারের গাছ থেকে সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজ-এর উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়িয়ে এখন বাংলাদেশে। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তরমুজের আবাদ হলেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এর আবাদ ও উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। যার সিংহভাগ অর্জনই দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি যোদ্ধাদের। আমাদের দেশে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
মূলত মৌমাছির সাহায্যে পরাগায়িত হয়ে এ ফলের উৎপাদন নিশ্চিত হয়। দেশে সুদূর অতীত থেকে ‘পতেঙ্গা’ ও ‘গোয়ালন্দ’ জাতের কালচে এবং নীলাভ গোলাকৃতির তরমুজের আবাদ হলেও তার মিষ্টতা বর্তমান প্রজন্মের চেয়ে কম ছিল। অধিক ফলন, মিষ্টতায় পরিপূর্ণ আধুনিক রসালো জাতের তরমুজের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশেও ক্রমে বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ইউরোপীয়, প্রাচ্য ও গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ‘টপইল্ড, গ্লোরী, কঙ্গো, চার্লসটনÑগ্রে, ইমিরিয়েল, জুবলী, সুপার ডেলিকেট, সুপার বেবী, সুইট ফেস্টিবল ও ফ্লোরিডা জয়েন্ট’ নামের একাধীক উন্নত জাতের তরমুজের আবাদ হচ্ছে। আমাদের কৃষি গবেষনা ইনষ্টিটিউট-বারি’র বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল সুমিষ্ট তরমুজের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
দক্ষিনাঞ্চলে চলতি মৌসুমে তরমুজের হেক্টর প্রতি ফলন ৪২ টনের মত বলে ডিএই জানালেও ‘বারি’ নির্দেশিত সুষম সার প্রয়োগ সহ আবাদ কৌশল অনুসরণ করলে উৎপাদন সহজেই ৫০ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলেও মনে করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। তবে এজন্য ডিএইর ব্লক সুপারভাইজারদের মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে আবাদ প্রযুক্তি পৌঁছানোর তাগিদ রয়েছে। পাশাপাশি তরমুজ প্রক্রিয়াজাত করে কোন ধরনের খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতেরও গুরুত্বারোপ করেছন পুষ্টিবীদ সহ কৃষি বিজ্ঞানীরা। তবে দেশ এখনো সে ধরনের কোন উদ্যোগ নেই।
বরিশালে দীর্ঘদিন ধরেই একটি ‘কৃষি ও মৎস ভিত্তিক রফতানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার দাবী সাধারন মানুষ সহ স্থানীয় চেম্বার অব কমার্সের। এ অঞ্চলের ইলিশ মাছ ছাড়াও উন্নতমানের পেয়ারা, আমড়া ও তরমুজ সহ অন্যান্য ফলÑফসলকে কেন্দ্র করে একটি রফতানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা প্রতিষ্ঠিত হলে তা এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশাবাদী অর্থনীতিবীদরা।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT