একজন হানিফ স্যার এবং কিছু স্মৃতিকথা! একজন হানিফ স্যার এবং কিছু স্মৃতিকথা! - ajkerparibartan.com
একজন হানিফ স্যার এবং কিছু স্মৃতিকথা!

3:16 pm , February 28, 2023

কাজী মিজানুর রহমান ॥ বরেণ্য শিক্ষাবিদ, শিক্ষার বাতিঘর অধ্যক্ষ প্রফেসর মো:হানিফ এর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী আজ ১ মার্চ।
মো:হানিফ! এতটুকুই তাঁর নাম, এটুকু লিখেই স্বাক্ষর করতেন। দেখতে ফর্সা, পরিপাটি পোষাকে ছোটখাট গড়নের এই মানুষটির বিশালতা যে কত ব্যাপক ছিল তা পরিমাপ করা আমার মত একজন সাধারনের জন্য সত্যিই কঠিন। শ্রদ্ধাভাজন হানিফ স্যার, অর্থনীতির অধ্যাপক, অন্তত কয়েক জেনারেশনের স্যার। অনেক শিক্ষকগণের শিক্ষক, কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক।
যাকে তিনি একবার দেখেছেন, কথা বলেছেন, অনেক বছর পরে দেখা হলেও নাম ধরে বলতে পারতেন -কিরে কেমন আছিস? এমন আদর আর সোহাগমাখা ডাক কোন শিক্ষকের কাছ থেকে আর কেউ কখনো শুনবে না। মিস করবে আমৃত্যু। আমি নিশ্চিত এখানে  তিনি অদ্বিতীয়।  স্যারের একটি ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতা ছিল, তাঁর  চোখের দিকে তাকিয়ে  বিরুদ্ধাচরন করার সাহস কারো ছিল না। তাঁর নামের আগে পিছনে যত বিশেষণ যোগ করা হোক না কেন, আপনি তৃপ্ত হবেন না। কি যেন নেই, কি যেন হলো না, অতৃপ্তি তাড়িয়ে বেড়াবেই।
বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন রোডে স্যার এসেছিলেন ১৯৫৬ সালে। আমার জন্মের কয়েক বছর আগে।
স্যারের বাড়ি বিমলাধাম এর  সামনের বেশ খানিকটা জায়গা পাকা করা ছিল।বহুদিন দেখেছি স্যার নিচু হয়ে রাস্তা ঝাট দিচ্ছেন। নিঃশব্দে দ্রুত পা চালাতাম পাছে দেখে ডাক দেন। মাথা তুলে দেখতে পেলেই বাসার কুশলাদী জানতে চাইতেন। ঋষিতুল্য এই মানুষটাকে রিকশা ব্যবহার করতে প্রায় দেখিইনি। বেশিরভাগ সময় হেঁটেই যাতায়াত করতেন। হাতেম আলী কলেজ তো বটেই, স্যারকে রাতের বেলাতেও দেখেছি বিএম কলেজ থেকে হেঁটে বাসায় ফিরতেন। দূরত্ব তার এই অভ্যাস বদলাতে পারেনি।
স্যার খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন, আমি কয়েকবার তাঁর খাবার সময় পাশে বসে দেখেছি।খাওয়া-দাওয়া ছিল অতি সাধারণ।
ধর্মীয় বিষয়েও স্যারের অগাধ জ্ঞান ছিল। কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে পড়াশুনা করে প্রস্তুতি নিয়ে যেতেন।
আমাদের পাড়ায় একটা সংগঠন ছিল, নবারুণ ক্লাব। স্যার সেই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। আর বয়সে অনেক ছোট আমি ছিলাম সেক্রেটারি। পরামর্শের প্রয়োজনে দেখা করতে হতো স্যারের সাথে। ব্যস্ত মানুষটাকে আলাদা করে পেতাম না এই কাজের জন্য, যেতে হতো তার চাকুরিক্ষেত্রে। হয়তো কখনো বিকেলে গিয়েছি তার কলেজে, গিয়ে দেখি রাস্তার কাজ হচ্ছে, তিনি নিজেই  ইটে পানি দিচ্ছেন। গাছ লাগানো হচ্ছে। সেখানেও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছেন। নিজের সন্তানের মতোই বরিশালের হাতেম আলী কলেজটাকে আগলে রাখতে দেখেছি তাকে। কলেজ অঙ্গন সবুজ করার অবদান অনেকটাই তাঁর। সবটুকু মনোযোগ দিয়ে কাজটা শেষ করে তবেই আমাদের সাথে কথা হতো তার। যদিও স্যারের স্বপ্ন, ধ্যানজ্ঞান সবই ছিল বিএম কলেজকে ঘিরেই। বিএম কলেজের আধুনিক কাঠামো পরিবর্তনের রূপকার, খ্যাতিমান এই শিক্ষক। অশ্বিনী কুমার দত্তের সত্য-প্রেম, পবিত্রতা, মূল আদর্শকে ধারন ও লালন করতেন। বরিশালের সমাজ, শিক্ষা, সংস্কারে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন সবসময়।
এলাকার প্রতি স্যারের একটা আলাদা মমত্ববোধ ছিল। এলাকার আমন্ত্রিত প্রায় অনুষ্ঠানেই তিনি নিজেকে যুক্ত করতেন।
কবি এ.কে. জয়নুল আবেদিনের শততম জন্মবার্ষিকী ও চল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী সম্মাননা অনুষ্ঠানে করোনাকালের মধ্যেই গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত প্রেস ক্লাবে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন।এটা সম্ভবত তার যোগদান করা শেষ অনুষ্ঠান ছিল কারন এর কয়েকমাস পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, চিকিৎসার জন্য ঢাকা যান।
১৯৭৮ সালে ফিরে তাকাতে চাই। তখন এশিয়ান যুব ফুটবল টুর্নামেন্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। বাংলাদেশসহ ২০টি দল অংশ নিয়েছিল সেখানে।  সম্ভবত এর আগে এত বড় ফুটবল খেলা ঢাকায় আর হয়নি। বাসায় টেলিভিশন ছিল না, এলাকায় কারো কারো টিভি থাকলেও রঙিন টিভি ছিল না। পাড়ার ছেলেরা মিলে বুদ্ধি করে স্যারের বাসায় গিয়ে খেলা দেখার কথা বললাম। আমাদের করুণ চাহনি দেখে স্যার বাসার সামনে টেবিলের উপর টিভি বসানোর ব্যবস্থা করলেন, আমাদের আনন্দ দেখে কে!
বাংলাদেশের প্রতিটা ম্যাচের দিনেই স্যার তার বাসার সামনে টিভির ব্যবস্থা করতেন আর এলাকার অনেকেই তখন খেলা দেখতে সেখানে বসে পড়তো।খেলার মধ্যে আমাদের উত্তেজনা,উল্লাস,চিৎকার স্যার স্নেহের চোখেই দেখতেন, এতটুকু বিরক্ত দেখিনি তাকে।
কি করে ভুলি দিনগুলো?
আমার শিক্ষাজীবন প্রায় শেষ তখন। ছবি,কাগজপত্র সত্যায়িত করার প্রয়োজন হলো। ওই সময়ে কাছাকাছি গেজেটেড অফিসার পাওয়া সহজ ছিল না। । একই  এলাকার  হওয়ার কারনে এসব কাজের জন্য স্যারের কাছেই যেতাম। একবার কি যেন সত্যায়িত করার প্রয়োজন হলো, জানলাম স্যার বাসায় নেই, ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করছি, রাত ১০টার সময় স্যার বাসায় ঢুকলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত অথচ  হাতের কাগজপত্র দেখে বিরক্তি প্রকাশ না করে বলে উঠলেন, কিরে, সত্যায়িত করতে হবে? খুশী মনে বাসায় ফিরলাম।
১৯৯২ সালের ৩০ ডিসেম্বর, বিএম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চাকুরির শেষ দিন ছিল স্যারের। ৫৭ বছর পূর্তিতে, যথাসময়ে অবসরে গেলেও রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারনে পেনশন মঞ্জুরি পেতে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। বেশ কয়েকবছর পরে তার পেনশন মঞ্জুর হয় আর সেসময়টাতে বরিশাল জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে চাকুরির সুবাদে তাৎক্ষনিকভাবেই আমার কাজটি করার সুযোগ হয়।
কোন একদিন আমাদের অফিসে এসে, কিছুটা ক্লান্ত শরীরে কাগজপত্র এগিয়ে দিয়ে বললেন, কিরে কেমন আছিস, নে তোদের কাজটা করে দে।
কাগজপত্র দেখে যতদ্রুত করা সম্ভব পেনশন বই তৈরী করে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। এ আমার এক অনন্য পাওয়া। আমাদের কাজের ফাঁকে স্যার কাউকে পাঠিয়ে অফিসের সকলের জন্য দুই কেস সেভেন আপ, মিরিন্ডা বা অন্য ব্রান্ডের কোল্ড ড্রিঙ্কস আনালেন। অফিসের পক্ষ থেকে সামান্য আপ্যায়ন শেষে স্যারকে এগিয়ে দিলাম। স্যারের হাতে পেনশন বইটি তুলে দিতে পেরে এখনো নিজেকে ধন্য মনে করছি।
একই পাড়ার হওয়াতে তার পরিবারের সাথে আমাদের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। হানিফ স্যার, খালাম্মা এবং তার ছেলে মেয়েরা কম-বেশি আমাদের বাসায় এসেছে। পেনশন বা চাকুরী সংক্রান্ত কাজে হানিফ স্যারের স্ত্রী (খালাম্মা) খবর দিলে কখনো আমি যেতাম কখনো বা তিনি নিজেই আমাদের বাসায় চলে আসতেন।আমার মায়ের সাথে অনেক গল্প করতে দেখেছি তাকে। শেষের দিকে শারীরিকভাবে খানিকটা অসুস্থ ছিলেন, রিকশায় উঠতে নামতে বেশ কষ্ট  হতো। কখনো আমার ছেলে তাকে রিকশা করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। আমার স্ত্রী, ছেলে মেয়েও স্যারের স্নেহ পেয়েছে, স্যারের নিজের হাতে বানানো চা, কফি খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এতটাই স্বাভাবিক, পারিবারিক সম্পর্ক ছিল দুটো পরিবারের মাঝে।
১লা মার্চ ২১ রাতে স্যারের বড় ছেলে পারভেজ এর পোস্ট থেকে জানতে পারলাম তিনি নেই, নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্ত মহালোকে। মুহুর্তে খবর  ছড়িয়ে পড়ল দেশ থেকে দেশের বাইরে। সবার মধ্যে স্বজন হারানোর বেদনা। চোখের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু ঝড়তেই  লাগলো। রাত পোহাতেই ধূসর সকালে বেদনায় জড়ানো অপেক্ষার পালা, কখন আসবেন শিক্ষার বাতিঘর এর শবদেহবাহী এম্বুলেন্স।
যখন নিথর, নিস্তব্ধ স্যারের দেহখানি তার বিমলাধাম এ পৌছলো তখন ঘড়ি সময় দেখাচ্ছিলো সকাল ৭টা বেজে ৫০ মিনিট।
১৯৫৬ সাল হতে এই বাড়িই ছিল তার ঠিকানা। আমার সৌভাগ্য আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম, তেমনি এই অক্সফোর্ড মিশন রোডেই আমার জন্ম।
বাহনখানি থামলো, গাস ভেদ করে দেখা গেল শান্ত, সৌম্য, স্থির মুখম-ল,এক সময়ের প্রাণবন্ত মানুষটা  যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেকেই আসছেন, মলিন বদনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নিঃশব্দে। কেউ কেউ উচ্চস্বরে শোক প্রকাশ করছেন। অশ্বিনীকুমার টাউনহলের সামনে বরিশালবাসির শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রিয় বিএম কলেজ মাঠে হাজারো বেদনার্ত মানুষের জানাযায় অংশগ্রহণ শেষে মুসলিম গোরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন আধুনিক বিএম কলেজের রুপকার  মো:হানিফ, ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের যবনিকা।
বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক,প্রিয় আখতারুজ্জামান একদিন ফোনে স্যারের বিষয়ে কিছু লিখতে বললেন, নিজেকে ভাগ্যবান, গর্বিত মনে হল। তাকে নিয়ে কথা বলা, লেখা খানিকটা দুঃসাহসই বটে। এত এত স্মৃতি তার সাথে, লিখতে চাইলে অনেকগুলো পৃষ্ঠা ভরে ফেলা যায় সহজেই,স্যার যে ছিলেন এক মুগ্ধকর।অসামান্য এক জীবন কাটিয়ে গেলেন ধুলোমাটির পৃথিবীতে।
২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই স্যারের অসুস্থতার প্রকোপ বাড়ছিলো। একই এলাকার সুবাদে খবরাখবর পেতাম। আখতারুজ্জামান সাহেব নিয়মিত খোঁজ নিতেন,বাসায় আসতেন। আরও কেউ কেউ এসেছেন তাও জানি। ওই পথ দিয়েই আমার বেশীরভাগ যাতায়াত কিন্তু স্যারের বিশ্রামের ব্যঘাত হবে, করোনার ব্যাপকতা, স্যারের বয়স সবকিছু মিলিয়ে আমি তার  রুমে ঢুকিনি। তাঁর বাবা মুনশী মকবুল আহমেদ শতায়ু হয়েছিলেন আর স্যারের মাত্র ৮৫, সে কথাও মনে আসত। ভাবতাম ভালো হয়ে যাবেন।
আসলে তিনি যে চলে যাবেন, সত্যিই এটা ভাবনায় আসেনি। যদি বুঝতে পারতাম আর কখনও দেখা হবেনা, কথা হবেনা ,আর কখনও স্যার বলবেন না, মিজান, তুই এসেছিস, আমি খুব খুশী হয়েছি।
স্ত্রীর মৃত্যুর দিনে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, ও চলে গেল, দোয়া করিস।
তাহলে আমি তার রুমে ঠিকই ঢুকতাম। বিধাতা আমার জন্য সেটুকু মঞ্জুর করেননি। মানুষের সব ইচ্ছা যেমন পূর্নতা পায় না তেমনি এই অতৃপ্তি, দুঃখবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে আমৃত্যু !

এই বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT