শোধিতে হবে যে ঋণ: আজ কবি জীবনানন্দের ১২৪ তম জন্মদিন শোধিতে হবে যে ঋণ: আজ কবি জীবনানন্দের ১২৪ তম জন্মদিন - ajkerparibartan.com
শোধিতে হবে যে ঋণ: আজ কবি জীবনানন্দের ১২৪ তম জন্মদিন

3:39 pm , February 16, 2023

হবে যে ঋণ: আজ কবি জীবনানন্দের ১২৪ তম জন্মদিন
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ কবি নামে ভ্রুকুঞ্চিত নমঃ তব শুদ্ধস্বর জপি
কবি নামে করি হানাহানি; সুতীব্র চিৎকার
বেচাকেনার বাজারে রোজ কবিদের দেনদরবার
কবিতা নয়; কবি সে কখনো সখনো বিকোয় চমৎকার। এভাবেই বর্তমান সময়ের কবিদের চিত্র তুলে ধরেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ প্রেমিক কবি সদানন্দ সরকার। কলকাতার বিরাটিতে বেড়ে ওঠা এই কবিও বরিশালের সন্তান। সদানন্দ বলেন, রূপসী বাংলার রূপের মুগ্ধতা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন যে কবি, যার জন্য বাংলার প্যারিস হয়েছে বরিশাল নগরী সেই জীবনানন্দ দাশের কাছে আমাদের অপূরণীয় ঋণ। যা শোধ করা কখনোই সম্ভব নয়, তবে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য অনেককিছুই করণীয় আছে আমাদের। আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে -এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,কবি জীবনানন্দ আবার ফিরে আসুক বা না আসুক তাঁর স্মৃতিচারণ ফিরে আসে বারবার। তেমনি এক স্মরণীয় দিন ১৭ ফেব্রুয়ারী। প্রকৃতি ও প্রেমের কবি, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের ১২৪ তম জন্মদিন আজ। অনেকে অনেক উপমা তাঁর আগেপিছে যুক্ত করলেও বিশ্ব ইতিহাসে ক্ষণজন্মা ও প্রচার বিমুখ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি জীবনানন্দ দাস- এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। এমনকি তাঁর সময়ের অনেকেই তাঁর বিরোধিতা করেছেন। একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই বুঝেছিলেন বাংলা কবিতায় একজন ভিন্নধারার কবির আগমন ঘটেছে এবং তিনিই সর্বপ্রথম সবাইকে জানিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশই ‘খাঁটি আধুনিক’ বাংলা কবি। এ-কথা সবারই জানা যে, বুদ্ধদে বসুর আগে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর কবিতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশংসার বাণী তো দূরের কথা, তাঁর সহকর্মীরা পর্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি সুধীন দত্তের মতো কবিও তাঁর পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা না ছেপে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এসবের কারণ হলো, তিনি ছিলেন দূরবর্তী সময়ের সচেতন কবি ব্যক্তিত্ব। তাঁর সময়ের সেই জনপ্রিয় কবি-পুরোহিতদের কেউ কেউ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন। স্ব দর্পে বেঁচে আছেন জীবনানন্দ আজো সাবলীল অহংকারে কবিতার বরপুত্র হয়ে। ১৮৯৯ সালের আজকের এই দিনে তিনি বরিশালের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন একজন কবি। সাংসারিক কাজের ফাঁকে তিনিও কবিতা রচনা করতেন। জীবনানন্দ মায়ের কাছ থেকেই সাহিত্যচর্চা ও কবিতা রচনার প্রেরণা লাভ করেন। জীবনানন্দ দাশ বিএম স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, বিএম কলেজ থেকে আইএ এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষপর্যন্ত তিনি পরীক্ষা দেননি। তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ১৯২২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগ দেন, কিন্তু কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু অল্পবয়স থেকেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে।
‘আমি কবি-সেই কবি, আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন কামনা জাগিছে প্রাণে ! (ঝরাপালক)
জীবনানন্দ দাশ নিঃসন্দেহে সর্বকালের সর্বোৎকৃষ্ট নিঃসঙ্গতার কবি। তাই সাড়ে আটশতের বেশী কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় তার নামের প্রতি কোন সুবিচার হয়নি বললেই চলে। হয়তো সেই অভিমানেই কবি লিখেছেন – “সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি (বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় ১৩৪৫, বৈশাখ সংখ্যা) জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী শত বৎসরে কবিতার বিনির্মাণ এবং কাঠামোগত বিন্যাস নিয়ে অনেক আধুনিক কবিরা তাদের বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। কেউ কেউ কবিতার শব্দের গাঁথুনির ওপর জোর দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ শব্দকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ভাষার মাধুর্যকে শিরধার্য করেছেন, কেউ আবার কবিতার ব্যাকরণগত দিক নিয়ে অনেক বেশি সচেতনতার কথা বলেছেন, কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতার শরীর জুড়ে ‘প্রশান্তির’র কথা বলেছেন। হাল আমলে প্রয়াত কবি শহীদ কাদরী বলেছেন, ‘কবিতা একটি ঘরের মতো যেখানে বসবাস করা যায়’। তবে কবিতা নিয়ে যে যাই কথা বলুক কবিতা হলো একটি গানের সুরের মতো। যে সুরটি আমাদের কানে নিত্য বাজে। সে কারণে কবি শহীদ কাদরী একবার কথায় কথায় বলেছিলেন ‘কবিতার জন্যে একটি কান থাকা খুব জরুরি।’ আর সে কানটি আজো হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে কারণে কবিদের সংখ্যা বাড়লেও কবিতার পাঠক আর বাড়েনি। ফলে সুবিচার বঞ্চিত বাংলার কামিনী রায়, সুফিয়া কামাল, সেকান্দর আবু জাফরসহ অনেক খ্যাতনামা কবি। আর কবি জীবনানন্দ দাশের সাথে আজো যে খুব একটা সুবিচার হচ্ছে তাও বলা যায় না। কেননা বরিশালে তাঁর জন্মভূমিতে তাঁকে ঘীরে নিজস্বার্থ চরিতার্থ করার অনেক চেষ্টা থাকলেও তাঁর স্মৃতি সমুজ্জ্বল রাখার খুব একটা উপকরণ চোখে পরেনা। কবি বেচাকেনার বাজারে বরিশালে জন্ম কবিদের কদর সবচেয়ে বেশি হলেও তা কিন্তু শুধু মৌখিক আস্ফালন। বাস্তবে কবি জীবনানন্দ কে ঘীরে ছোট্টো একটি পাঠাগার মিলনায়তন ছাড়া আর কিছু নেই। সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ প্রতি বছর জীবনানন্দ মেলা ও পদকের অযুহাতে সরকারি, বেসরকারি অনুদান সংগ্রহ আছে বটে, পদক ও সম্মাননা বিতরণও হয়, তবে সেজন্য কোনো নির্দিষ্ট জীবনানন্দকে ঘিরে ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি আজো। একটা সময় বরিশালে জীবনানন্দের ধারক-বাহক হিসেবে পরিচিত কবি হেনরী স্বপন জীবনানন্দ নামে পত্রিকা করে বেশ আলোড়ন ফেলেছিলেন সারা বাংলাদেশে। পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক ও পারিবারিক সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায় বলে জানা যায়। তবে কবি হেনরী স্বপন বলেন, একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি, এখন কখনো-সখনো বছর -দু’বছরে একবার হলেও জীবনানন্দ পত্রিকাটি করার চেষ্টা করি। তবে এখানে চারিপাশে সাহিত্যিক নামধারীরা কবি জীবনানন্দকে যেভাবে বাজারে বিক্রি করছে তাতে এতোদিনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টি কবি জীবনানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত ছিল। তা না হোক ওখানে পৃথকভাবে কবি জীবনানন্দ দাশ গবেষণার হতে পারতো। জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনেই বাণিজ্য খুঁজে পেয়েছেন এখানের কতিপয় কবি নামধারী লোক। বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ অবশ্য এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে কোনো কবিকে ঘীরে কতটা বাণিজ্য করা সম্ভব তা যারা জীবনে কোনোদিন উৎসব আয়োজন করেননি তারা কি করে বুঝবেন ? বরিশালে জীবনানন্দকে বাঁচিয়ে রেখেছে জাতীয় কবিতা পরিষদ বরিশাল ও বিএম কলেজের উত্তরণ।নজমুল হোসেন আকাশ আরো বলেন, হাঃ এটা সত্যি যে কবি জীবনানন্দ দাশ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হলেও তাকে ঘীরে বরিশালে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্থাপনা আজো তৈরি হয়নি এটা অবশ্যই আমাদের বড় ব্যর্থতা। একটি জীবনানন্দ স্মৃতি একাডেমি বা পাঠাগার যা হয়েছে তাও অনেক আন্দোলনের ফলে পেয়েছি। সেটাও সাংস্কৃতিক আয়োজনের অনুপযোগী। একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে বটে, তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানই সে নামকরণ ব্যবহার করেনা। আসলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে এটা স্বীকার করতেই হবে। বরিশালে কবি জীবনানন্দ সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমন দাবী তোলা হয়েছিল ২০১৪ সালে সাহিত্য বাজার পত্রিকার ময়মনসিংহ উৎসবে। সেইসময় সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং সাংস্কৃতিক সচিব প্রয়াত ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। যা আজও কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে বরিশাল সাহিত্য সংসদের দাবীর মুখে বিষয়টি নিয়ে বরিশালের সাবেক জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জীবনানন্দ ইনস্টিউট ও নজরুল সাংস্কৃতিক একাডেমি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যা এখনো ফাইলবন্দী রয়েছে স্বীকার করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, শুধু জীবনানন্দ দাশ নয়, জাতীয় কবি নজরুল সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র এবং আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়েও উল্লেখযোগ্য কিছু করার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিন্তাভাবনা রয়েছে। আশাকরি বৈশ্বিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই আমরা একাজগুলো শুরু করতে পারবো।

এই বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT