3:48 pm , February 11, 2023

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৫৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ১০/১২টি পাবলিক টয়লেট থাকলেও বেশিরভাগই বন্ধ বা বেদখল হয়ে আছে। এসব পাবলিক টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারোপযোগী করা হলে আয়ের উৎস যেমন বাড়তে পারে তেমনি সু-পরিকল্পিত পদক্ষেপে এগুলো থেকে উৎপাদন হতে পারে নিজস্ব বায়োগ্যাস। যা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব বলে মতামত দিয়েছেন নগর চিন্তাবিদদের অনেকে। যদিও নগরীতে কতগুলো পাবলিক টয়লেট বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) কর্তৃপক্ষের কেউই সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।
তবে শনিবার অনুসন্ধানে বরিশালের স্বাধীনতা পার্ক, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চরকাউয়া খেয়াঘাট সংলগ্ন ৪টি পাবলিক টয়লেট তালাবদ্ধ এবং অযতœ অবহেলায় ভঙ্গুর অবস্থায় দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে একটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও সেটিও ব্যবহার অনুপযোগী। শুধুমাত্র নথুল্লাবাদ, রূপাতলী ও একতলা লঞ্চঘাট সংলগ্ন বহু পুরাতন পাবলিক টয়লেটটির যথাযথ ব্যবহার চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য যে, একতলা এই লঞ্চঘাটের পাবলিক টয়লেটটি ছাড়া আর একটিও পরিচ্ছন্ন ও সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী মনে হয়নি। এখানের ইজারাদার মিন্টু জানান, একতলা লঞ্চঘাটের এই পাবলিক টয়লেটটি সাবেক পৌরচেয়ারম্যান গোলাম মাওলার সময়ে তৈরি। এর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বাড়লেও আকার আকৃতি বাড়েনি।
মিন্টু তার পাবলিক টয়লেটটি এতোটাই পরিচ্ছন্ন রেখেছেন যে রীতিমতো ভিতরের কাউন্টারে বসে চা পানের উপযোগী। চা খাওয়ার ফাঁকেই তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে আমি এখানে বায়োগ্যাস প্লান কার্যকর করতে আগ্রহী। তাহলে আশেপাশের দোকান ও এখানে নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে বলে শুনেছি।
কিভাবে শুনেছেন? প্রশ্নের উত্তরে মিন্টু জানান, ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে একগ্রামে এটি চালু আছে। সেখানে কাজ করেছেন এমন একজন কর্মী বলেছেন যুব উন্নয়ন নাকি এটি করছে।
বিষয়টির সমর্থনে তথ্য দিলেন নগর চিন্তাবিদ ও বরিশাল অর্থনীতি সমিতির সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, পার্কে অনেক মানুষের উপস্থিতি থাকে সবসময়। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিনে বিভিন্ন সংগঠন পার্কে অনুষ্ঠান করে। মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও বঙ্গবন্ধু উদ্যানে পাবলিক টয়লেট থাকার পরও তা ব্যবহার করা যায়না এটা কষ্টদায়ক। পরিকল্পিত নগরায়নে পাবলিক টয়লেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বেকারত্ব দূর করতে পারে। ঢাকায় এখন সেটা প্রমাণিত হয়েছে বলে জানান কাজী মিজানুর রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সাভারের হেমায়েতপুরের যাদুরচরে ‘মানব বর্জ্য’কে কাজে লাগিয়ে বায়োগ্যাস প্লান্ট কার্যকর করেছে এক যুবক তাসেক। ২০১৩ সালে লন্ডনপ্রবাসী তাসেক ১৯টি গরু-মহিষ নিয়ে একটি খামার গড়ে তোলেন। গরুর গোবর দিয়ে প্রথমে তিনি একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করেন। সেই প্লান্ট থেকে ৩৫০ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে।
এ প্লান্টের কাজ শেষ হওয়ার পরপরই তিনি মানব বর্জ্য দিয়ে তৈরি করেছেন আরো একটি ‘ফাইবার গ্যাস বেইজ বায়োগ্যাস প্লান্ট’। সম্পূর্ণ চায়নার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব বর্জ্য থেকে তৈরি বায়োগ্যাস থেকে দৈনিক ৮৪ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে বলে জানান তিনি। এ বায়োগ্যাস দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ ছাড়াও জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে বিদ্যুৎ। উৎপাদিত এ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে খামারের বিভিন্ন কাজে। শুধু তাই নয়, খামারের পাশের কয়েকটি বাড়িতে বায়োগ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনাকারী প্রতিষ্ঠান রহমান রিনিউবল এনার্জি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেদওয়ানুর রহমান বুলবুল ওই সময় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মানব বর্জ্য দিয়ে ‘ফাইবার গ্যাস বেইজ বায়োগ্যাস প্লান্ট’ তৈরি করতে দুই দিন সময় লাগে। এতে ব্যয় হয় এক লাখ ৫ হাজার টাকা। তবে এ প্রকল্পটি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিপি) ভতুর্কি দিচ্ছে ৬৯ হাজার টাকা আর গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৩৬ হাজার টাকা।
তিনি আরও বলেন, এডিপির অর্থায়নে সারা বাংলাদেশে ৫০টি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হবে। এরমধ্যে ঢাকা জেলার সাভার ও ধামরাইয়ে ৬টি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে।
এরপর ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকার বায়োগ্যাস প্লান্টে গুরুত্ব আরোপ করে এবং দেশের ৬৪ জেলায় বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর’কে দায়িত্ব দেয়। এতে বলা হয়, প্রতি জেলায় ১ হাজার করে মোট ৬৪ হাজার বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে খামার স্থাপন করে মোট ১ লাখ ২৮ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি (প্রতি খামারে ন্যূনতম দুজন) করা হবে। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। রিভলভিং ক্রেডিট ফান্ড পরিচালনা করা হবে ১২৫ কোটি টাকার। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে যুবসম্পদে রূপান্তর করে প্রকল্পটি সংগতিপূর্ণ হওয়ায় এটি অনুমোদন দেয়া হয়।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তখন জানিয়েছিলেন, দেশের সব জেলায় বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি সংকট নিরসন হবে। পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়বে। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা দিয়ে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বরিশালে এই মানব বর্জ্য ব্যবহারে বায়োগ্যাস প্লান্ট কার্যকর বিষয়ে যুব উন্নয়ন দপ্তর কতটা তৎপর তা জানা যায়নি। তবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপজেলা কর্মকর্তা দীনা খান জানালেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রকল্পটি আপাতত বন্ধ রয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেই আমরা পুনরায় কাজ শুরু করবো।