3:31 pm , February 9, 2023
চারদিনে সাত জনের আত্মহত্যা
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশালের বিভিন্ন উপজেলায় আত্মহত্যার প্রবনতা বাড়ছে। গত চার দিনে ৭ জন আত্মহত্যা করেছে। এছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টায় বিষপান করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরো কয়েকজন। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করা আগৈলঝাড়া থানার ওসি গোলাম সরোয়ার বলেন, এ দুই উপজেলার মানুষ আবেগ প্রবন। সামান্য বিষয়ে অভিমানী হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
ওসি সরোয়ার বলেন, এক সময় এ উপজেলা যোগযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত ছিলো। যার কারনে অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিলো না। সহজে কোথাও যেত না। তাই তাদের মধ্যে আবেগ বেশি। বর্তমানে এলাকার পরিবর্তন হলেও সেই আবেগ কাটেনি। বকা-ঝকা করা, অপমানসুচক কথা কিংবা মনে আঘাত পেলেই আত্মহত্যা করে। তাই এলাকার লোকজনেরসাথে কথা বলতে হয় সাবধানে।
তিনি জানান, গত দুই দিনে চারজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে দুইজন মারা গেছে। দুই জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ওসি সরোয়ার বলেন, গত দুই বছর ধরে আগৈলঝাড়া থানায় দায়িত্বপালন করেন। এ সময়ের প্রতি মাসে ২ থেকে ৫ জন করে আত্মহত্যার ঘটনা পান বলে দাবি করেন।
আগৈলঝাড়া উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিক একেএম আজাদ রহমান বলেন, এ উপজেলা কৃষি নির্ভর। তাই এখানে কীটনাশক সহজলভ্য। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া, কিংবা অভিভাবকরা বকা দিলে ঘরে থাকা কীটনাশক সেবন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এতে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা যুবক, যুবতীসহ শিশু কিশোর-কিশোরীও রয়েছে।
ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতা পেশায় থাকা আজাদ রহমান বলেন, প্রতি বছর অন্তত একশ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এর মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যায়। ৬০ ভাগ চিকিৎসায় সুস্থ হয়।
তিনি জানান, গত ৩ ফেব্রুয়ারী উপজেলার রতœপুর ইউনিয়নের রতœপুর গ্রামের দরিদ্র ভ্যান চালক বিপ্লব চৌধুরীর মেয়ে ও রতœপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়–য়া ছাত্রী পায়েল চৌধুরী আত্মহত্যা করে।
শিশুর পরিবার ও আগৈলঝাড়া থানার এসআই আলী হোসেনের বরাতে বলেন, পায়েল চৌধুরী ধানের বীজ উঠিয়ে মা আরতি চৌধুরীর কাছে কিছু টাকা জমা রাখে। ওই টাকা দিয়ে পায়েল স্কুলড্রেস তৈরীর করে দেয়ার জন্য পিতা-মাতার কাছে দাবী করে। ওই টাকা অন্য কোথাও খরচ করতে নিষেধ করে। এ কারনে পিতা-মাতা পায়েলকে বকাঝকা করে। এই অভিমানে স্কুল ছাত্রী পায়েল পিতা-মাতার উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে তাদের অনুপস্থিতে নিজ ঘড়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে।
সোমবার ৬ ফেব্রুয়ারী সকালে আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের বড় বাশাইল গ্রামের সতীশ চন্দ্র মজুমদারের ছেলে বিধান মজুমদারের (৩৮) লাশ উদ্ধার করা হয়।
আগৈলঝাড়া থানার এসআই আলী হোসেন বলেন, ছয়মাস পূর্বে বিধান মজুমদার ব্রেইন স্ট্রোক করেন। এরপর থেকে বিধান মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ যন্ত্রনা থেকে রক্ষা পেতে পরিবারের সকলের অগোচরে রবিবার রাতের যে কোন সময় ঘর থেকে বের হয়ে গাছের সাথে গলায় ফাঁস দেয়। সোমবার সকালে পরিবারের সদস্যরা লাশ ঝুলতে দেখে পুলিশে খবর দেয়। তারা গিয়ে লাশ উদ্ধার করেন। পরে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতিতে বিনা ময়না তদন্তে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের ভাজনা বাহাদুরপুর গ্রামের ইউনুস ঢালীর মেয়ে হাফিজা বেগম (১৭), মুড়িহার গ্রামের মনির বেপারীর স্ত্রী শাহিনুর বেগম (৪৫) ও সুজনকাঠি গ্রামের বাবুল দে’র মেয়ে অংকিতা দে (১৮)। পারিবারিক কলহে তিনজন বিষপান করেন বলে ওসি গোলাম সরোয়ার জানিয়েছেন। এর মধ্যে হাফিজার মৃত্যু হয়েছে।
গৌরনদী মডেল থানার কর্তব্যরত অফিসার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২৫ দিনপূর্বে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইছাহাক ঘরামির ছেলে থ্রি-হুইলার (মাহিন্দ্রা) চালক জসিম ঘরামী (৩২)। ৬ ফেব্রুয়ারী সকালে মারা গেছে সে।
জসিমের বন্ধু ও থ্রি হুইলার চালক সাগর বলেন, সুদের টাকার জন্য গত ২৫ জানুয়ারি বিকেলের দিকে গৌরনদীর বার্থী বাসস্ট্যান্ডে তাকে মারধর করা হয়। সেখান থেকে বাড়ি গিয়েই জসিম কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ৬ ফেব্রুয়ারী বিকেলে নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে নুপুর মন্ডল (২৪)। সে গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নের দক্ষিণ পশ্চিমপাড়া গ্রামের সুধীর মন্ডলের মেয়ে। নুপুর বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের মাষ্টার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলো।
পরিবারের বরাতে পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হেলালউদ্দিন বলেন, নুপুরের সাথে পাশের হরহর গ্রামের পঙ্কজ দাস নামে এক যুবকের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। সম্প্রতি তারা বিয়ে করে। এ নিয়ে পারিবারিক কলহ দেখা দেয়। তাই আত্মহত্যা করেছে নুপুর।
পরিদর্শক হেলাল বলেন, দায়িত্ববোধ, পারিবারিক সুশিক্ষা, সচেতনতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বেশি। এ থেকে পরিত্রান পেতে জীবনের পরিমাপ, মুল্যেবোধ ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতামুলক শিক্ষা দিতে হবে।
এ রেশ কাটতে না কাটতেই বাবুগঞ্জে পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী এর সাথে ঝগড়া করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন মোঃ সাইফুল ইসলাম ছুলুম (৩৫) । বুধবার বিকাল ৪ টার দিকে উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের ওলানকাঠী গ্রামে নিজ বাসা থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
একই দিন বাকেরগঞ্জ উপজেলায় তিন সন্তানের জনক আত্মহত্যা করেছে। আত্মহননকারী মিজানুর রহমান (৫২) বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের সামছুল আলমের ছেলে। দাড়িয়াল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) শহিদুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, মৃত মিজানুর রহমান দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তার স্ত্রী ফাতেমা রহমান দাঁড়িয়াল ইউনিয়নের কালেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সেই সুবাদে কামারখালি বাজার সংলগ্নে একটি ভাড়া বাসায় তিন সন্তান নিয়ে মিজান ও ফাতেমা দম্পতি থাকতেন। পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ধারালিয়া গ্রাম পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির এলাকার ডুবি গ্রামের বাসিন্দা জাহান আরা বেগমের (৫৫) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বানারীপাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ মোমিন উদ্দিন জানান, ধারালিয়া গ্রামে এক বাড়ির পুকুর পাড়ের আম গাছের সাথে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রথমে লাশটির পরিচয় না পাওয়া গেলেও পরে জানা যায় তার বাড়ি স্বরূপকাঠি এলাকায়।
জাহান আরা বেগমের স্বজনদের বরাতে বলেন, ওই নারী দীর্ঘদিন ধরে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সেই কারনেই হয়তো তিনি আত্মহত্যা করেছেন।