3:52 pm , February 7, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় এবার প্রায় আড়াই লাখ টন গোল আলু উৎপাদনের আশা করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদ সহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র। স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের পরে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’এ ভর করে অতি বর্ষণের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে মাঠে মাঠে এখন গোলআলু তুলছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধারা। তবে বিএডিসি থেকে উন্নতবীজ সরবরাহ না করার সাথে উৎপাদন ব্যয় না ওঠায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের আলু আবাদে এখনো আগ্রহী করা সম্ভব হয়নি। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা বিধায় দক্ষিণাঞ্চলে কিছুটা বিলম্বেই রবি মৌসুম শুরু হওয়ার কারণে আবাদ ও উৎপাদন বিলম্বিত হয়ে থাকে। চলতি মাস জুড়েই দক্ষিণাঞ্চলে গোল আলু উত্তোলন করা হবে।
তবে ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ উদ্ভাবিত উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল আলু বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর পাশাপাশি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করলে দক্ষিণাঞ্চলেই গোল আলুর আবাদ ও উৎপাদন অন্তত দেড়গুন বৃদ্ধি সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিবীদরা। ‘বারি’ ইতোমধ্যে ‘বারি আলুÑ১ (হিরা), বারি আলুÑ৪ (আইলসা), বারি আলুÑ৭ (ডায়মন্ট), বারি আলুÑ৮ (কার্ডিনাল), বারি আলুÑ১১ (চমক), বারি আলুÑ১২ (ধীরা), বারি আলুÑ১৩ (গ্রানোলা), বারি আলুÑ১৫ (বিনেলা), বারি টিপিএসÑ১ ও বারি টিপিএস-২’ নামের একাধিক উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল আলুবীজ উদ্ভাবন করেছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত এসব উন্নতমানের বীজ থেকে হেক্টর প্রতি ১০-১২টন পর্যন্ত গোল আলু উৎপাদন সম্ভব। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, গোল আলুর ভাল ফলন পেতে উন্নতমানের বীজ বপনের কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি ভালভাবে জমি তৈরীর বিষয়টির ওপরও গুরুত্বারোপ করেছন কৃষিবীদরা। এক্ষেত্রে সুষম সার প্রয়োগের বিষয়ে সম গুরুত্ব প্রদানের কথা বলেছেন কৃষিবীদরা।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে প্রতি হেক্টরে ২২০Ñ২৫০ কেজি ইউরিয়া, ১২০Ñ১৫০কেজি টিএসপি, ২২০Ñ২৫০ কেজি এমপি, ১০০Ñ১২০ কেজি জিপসাম ও ৮Ñ১০কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি অম্লীয় বেলে মাটির জন্য ৮০Ñ১শ কেজি ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও বেলে মাটির জন্য ৮Ñ১০কেজি বোরন সার প্রয়োগ করতে হবে। উপরন্তু যেকোন ধরণের জমিতেই গোল আলু আবাদে হেক্টর প্রতি ৮Ñ১০টন পর্যন্ত গোবর সার প্রয়োগেরও তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদরা।
চলতি রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলার মধ্যে পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর,বরগুনা,ঝালকাঠী ও বরিশাল জেলায় ৭ হাজার ৯৭৮ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরিতে ৮ হাজার ১৭৮ হেক্টরে গোলআলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার টন। তবে বাড়তি ১ হাজার হেক্টর আবাদের ফলে উৎপাদন লক্ষ্যও অতিক্রম করবে বলে আশাবাদী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।
অপরদিকে ফরিদপুর,শরিয়তপুর,মাদারীপুর,রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ জেলায় ২ হাজার ৬৬৪ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ৩ হাজার ৩৯২ হেক্টরে গোল আলুর আবাদ হয়েছে বলে ডিএই সূত্রে জানা গেছে। ফলে ৬০ হাজার ৫৭ হেক্টর উৎপাদন লক্ষ্য প্রায় ৭০ হাজার টনে উন্নত হবার ব্যপারেও আশাবাদী কৃষিবীদরা।
তবে দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী জমিতে গোল আলু আবাদ ও উৎপাদন সম্ভব হলেও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষি যোদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বীজ, সার ও কৃষি শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির ফলে চলতি মৌসুমে প্রতিকেজি আলুর উৎপাদন ব্যয় ১৫ টাকার ওপরে পৌঁছলেও মাঠপর্যায়ে চাষীরা ১০ টাকায় তা বিক্রী করতে পারছেন না। এমনকি কৃষক পর্যায়ে ১০ টাকার গোল আলু প্রথমে পাইকারী পর্যায়ে ১৮ টাকা থেকে এখন ২৩ টাকায় উঠলেও উৎপাদকদের ভাগ্য খোলেনি।
ডিএই’র মতে ২০০৭Ñ০৮ কৃষিবর্ষে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১টি জেলায় ১২ হাজার ৬৯২ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৪ হাজার ৬৪৮ হেক্টরে গোল আলুর আবাদ হয়। প্রায় সোয়া ২ লাখ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও প্রকৃত উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৩.২৭ লাখ টন। ন্যায্য দাম না পাওয়া সহ সংরক্ষনে কৃষকরা চরম বিড়ম্বনায় পরের বছরই আলুর আবাদ ও উৎপাদনে ধ্বস নামে। ২০০৮Ñ০৯ কৃষিবর্ষে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টরে গোলআলু আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত আবাদ হয়েছিল ১০ হাজার ৫৯৮ হেক্টরে। আর উৎপাদনও আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১.৩০ লাখ টন হ্রাস পেয়ে ১.৯৮ লাখ টনে স্থির ছিল। ২০০৯Ñ১০ কৃষিবর্ষে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করে ৮ হাজার ১২ হেক্টরে নির্ধারন করা হলেও প্রকৃত আবাদ ছিল ১০ হাজার ৭৬৩ হেক্টরে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রনালয় ১ লাখ ৩৪ হাজার টন গোল আলু উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারন করলেও প্রকৃত উৎপাদন ছিল ২.২৩ লাখ টন যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯০ হাজার টন বেশী ছিল । ২০১০-১১ কৃষিবর্ষে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের জন্য কৃষি মন্ত্রনালয় ১০ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমিতে গোলআলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করলেও বাস্তব আবাদ ছিল ১০ হাজার ৬০৫ হেক্টরে। যা ওই বছরের লক্ষ্যমাত্রা এবং আগের বছরের প্রকৃত আবাদের চেয়েও কম ছিল।
তবে ২০১১-১২ কৃষিবর্ষে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ১.৯১ লাখ টন গোলআলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করলেও এ অঞ্চলের চাষীদের নিরলস পরিশ্রমে তা ২.৩৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে তা প্রায় একই পর্যায়ে থেকে চলতি রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে ১০ হাজার ৬৪২ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১১ হাজার ৫৭০ হেক্টরে গোলআলুর আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। উৎপাদনও প্রায় আড়াই লাখ টনে উন্নীত হবার বিষয়ে আশাবাদী কৃষিবীদরা।