দাড়টানা নৌকার মতোই বিলুপ্ত এখন দাঁড়িয়াবান্ধা, ফিরে আসুক গোল্লাছুট দাড়টানা নৌকার মতোই বিলুপ্ত এখন দাঁড়িয়াবান্ধা, ফিরে আসুক গোল্লাছুট - ajkerparibartan.com
দাড়টানা নৌকার মতোই বিলুপ্ত এখন দাঁড়িয়াবান্ধা, ফিরে আসুক গোল্লাছুট

3:42 pm , February 6, 2023

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দাঁড়িয়াবান্ধা গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া অনেকগুলো খেলার একটি। অনেকটা দাড়টানা নৌকার গুলুইয়ে দাঁড়িয়ে পানিতে না পরে ছুটে বেড়ানোর মতোই এই খেলার ধরণ। সেই দাড়টানা নৌকার সাথে সাথে বিলুপ্ত এখন দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা। এ খেলার মজাটাই ভীষণ। খোলামাঠে দাগ কেটে বা মাটিতে চকের গুড়ো বিছিয়ে কোট বা খেলার ঘর তৈরি করা হয়। তারপর খেলার শুরুতেই বিভিন্ন রকম ছড়া বা শ্লোক পড়তে পড়তে মাঠে নামা পক্ষ বিপক্ষের খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। একপক্ষ চড়া দাগের মধ্যে অনেকটা নৌকার গুলুইয়ে ছুটে বেড়ানোর মতোই ছুটে ছুটে প্রতিপক্ষের ঘর পার হওয়া ঠেকাবে।আর অন্যপক্ষ ঘর পার হতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেবে।
ঘর পার হতে তারা বিভিন্ন শ্লোক বা কবিতা  আবৃত্তি করে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে। এসময় তারা আবৃত্তি ও অভিনয় করে…
এক ছিল দাড়িমাঝি দাঁড়ি তার মস্ত
দাঁড়ি দিয়ে দাড়ে তার দাঁড়িগুলো ঘষতো। কিম্বা
ছুঁইতে পারলে ছোঁ
না পারলে কাঁথামুরে শো।
এরকম শ্লোক বা লোককথায় মুড়ানো গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি খেলার নাম দাঁড়িয়াবান্ধা। বরিশালের তালুকদার হাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বরিশাল শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর তালুকদার গত ৪ ফেব্রুয়ারী তার বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে  এই ঐতিহ্যবাহী বিলুপ্ত খেলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, একটা সময় ছিলো যখন এই বরিশালের নতুন কাটা ধানের খেতে বিকেলের সোনালী রোদে এই দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার আয়োজন হতো। দূর দূরান্ত থেকে মানুষেরা ভীড় জমাতো এই খেলা দেখার জন্য। এছাড়াও এই স্কুলের মাঠেই নিয়মিত হাডুডু, গোল্লাছুট, কানামাছি ও ভলিবল খেলা হতো। খেলাধুলা শিক্ষার্থীদের মন পবিত্র রাখে তাই বিদায় লগ্নে এই খেলাগুলো চর্চা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান শিক্ষক নেতা জাহাঙ্গীর তালুকদার।
এই খেলার শুরুতেই আগে মাঠ বা খেলার স্থান নির্ধারণ করা হতো। এ খেলার মাঠটি ৫০/৬০ ফুট লম্বা ও ২০/৩০ ফুট চওড়া হতো। মাঝখানে সমান্তরাল লম্বা ও ১ ফুট চওড়া একটি দাগ বা রেখা করে দুটো ভাগ করা হতো। এই ভাগ থেকে ১ ফুট অন্তর আড়াআড়ি ৪টি বা ৫টি লাইনে পুরো কোটটি ১০ বা ১২ ফুটের ১০টি খোপ বা ঘরে ভাগ করা হতো। আড়াআড়ি ৬টি বা ৮টি লাইন একফুট চওড়া হবে। প্রত্যেক দলে ৬/৮ জন করে খেলোয়াড় থাকে। খেলোয়াড় বেশি হলে ও কোট বড় হলে কোথাও কোথাও ১২ জন করেও খেলোয়াড় হতে পারে। টস করে আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষাকারী স্থির করা হয়। ২৫ মিনিট খেলা, ৫ মিনিট বিশ্রাম, আবার ২৫ মিনিট খেলা- এই নিয়মে খেলা চলে। খেলার সময় একজন ধরা পড়লে বা ছোঁয়া পেলেই অন্যদলের অর্ধাংশ আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। খেলার ফলাফল অমীমাংসিত থাকলে ১০ মিনিট বাড়িয়ে আবার খেলে খেলার ফলাফল নির্ধারণ করা যায়। প্রতিটি আড়াআড়ি একফুট চওড়া দাগের ভিতর একজন করে খেলোয়াড় দাঁড়ায়। এখানেই দাঁড়িয়ে অন্য দলের খেলোয়াড়দের ঘরের ভেতর ঢুকতে বাধা দেয় সে। কোটের ওপর বা ঘরের ভেতর অন্যদলের খেলোয়াড়কে ছুঁতে পারলে সে ধরা পড়ে। এভাবেই জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় এই দাঁড়িয়াবান্ধা খেলায়।
এ খেলার নাম কেন দাঁড়িয়াবান্ধা হলো তা জানা না গেলেও গবেষকরা মনে করেন, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপরপক্ষকে বাধা দেয়ার কারণেই এ খেলার নাম দাঁড়িয়াবান্ধা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, এ খেলার প্রচলন দাড়টানা নৌকার মাঝিরা করেছেন, তাই এই খেলার নাম দাঁড়িয়াবান্ধা হয়েছে। তবে যে যাই বলুক এ খেলা খেলতে নেমেই খেলোয়াড়েরা যে শ্লোক বলতো তাও কিন্তু খুবই উপকারী ও শিক্ষনীয় শব্দের খেলা। বিশেষ করে দাঁড়ি দিয়ে দাড়ে তার দাঁড়িগুলো ঘষতো- এ শ্লোক বা পদ্য পঙক্তি আবৃত্তি ও নাট্যচর্চায় খুবই উপকারী হিসেবে ব্যবহার হয়। এখানে খেলোয়াড়েরা নিজের অজান্তেই বাক্যের অনুপ্রাস তৈরি করছে। এরকম আরো অনেক খেলা গ্রামবাংলায় তথা এই বরিশাল অঞ্চলের মাটিতে লুকানো আছে যেখানে খেলার পাশাপাশি মজার মজার ছড়া শিক্ষানো যায় শিশুদের।  গ্রামগঞ্জ থেকে সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে বিলুপ্তি ঘটছে এরকম অনেক শিক্ষনীয় খেলা।পল্লী গবেষক পঞ্চানন রায় বলেন, আগে বিভিন্ন গ্রামীণ উৎসবে মেলা হতো। সেখানে প্রতিযোগিতামূলক নানা খেলার আয়োজনও থাকতো। দাঁড়িয়াবান্ধা,  হাডুডু, গোল্লাছুট ইত্যাদি কত খেলা।
‘এখন আকাশ সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ খেলাগুলো হচ্ছে না। বুদ্ধির খেলা ষোলঘুঁটিও আর নেই বলে আফসোস করেন তিনি। তবে লোকজ খেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন লোক গবেষক ড. তপন বাগচি । তিনি বলেন, শুধু দাঁড়িয়াবান্ধা নয়, গোল্লাছুট, হাডুডু এই খেলাগুলো আজো গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও টিকে আছে। এগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে স্কুল কলেজে এই খেলার প্রচলন ঘটানো জরুরী।
গোল্লাছুট খেলাটির জন্য নির্দিষ্ট বড় মাঠের প্রয়োজন হয়না। ছোট মাঠ বা বাড়ির আঙ্গিনায় এ খেলাটি শিশু কিশোরদের খুব প্রিয় খেলা ছিলো আশির দশকেও। বিশেষ করে ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, খুলনা ও পাবনায় এ খেলার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। গোল্লাছুট খেলায় দুটি দল থাকে। মাটিতে এক জায়গায় গর্ত করে একটি লাঠি পুঁতে তাকে কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। এই লাঠিকে কেন্দ্র করে বৃত্ত তৈরি করে ২৫-৩০ ফুট দূরে আরও একটি রেখা টেনে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। বৃত্ত তৈরি করে ঘুরতে হয় বলে একে ‘গোল্লা’ এবং আঞ্চলিক ভাষায় ছুট হল দৌঁড়ানো। গোল্লা থেকে বের হয়ে ছুটতে হয় বলেই এ খেলাটি গোল্লাছুট নামে পরিচিত। খেলার শুরুতে দু’জন দলপতি নির্ধারণ করা হয়। দলপতিদের বলা হয় ‘গোদা’। দু’দলেই সমান সংখ্যক খেলোয়াড় থাকে (৫ অথবা ৭ জন)। দলপতি মাটিতে পুঁতে রাখা কাঠি এক হাতে ধরে অপর হাতে তার দলের অন্য খেলোয়াড়ের হাত ধরে থাকে। এভাবে তারা পরস্পরের হাত ধরে কেন্দ্র স্পর্শ করে ঘুরতে থাকে। তাদের লক্ষ্য হল বৃত্তের বাইরে যে কাঠি বা গাছ (দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু) থাকে তা দৌঁড়ে স্পর্শ করা।অপরদিকে দৌঁড়ে কাঠি স্পর্শ করার আগেই বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা যদি ওই দলের কোনো খেলোয়াড়কে স্পর্শ করতে পারে তাহলে সে এই দানে (পর্ব) খেলা থেকে বাদ যাবে। এভাবে শেষ পর্যন্ত দলপতিকেও দৌঁড়ে কাঠি স্পর্শ করতে হয়। কোনো খেলোয়াড় যদি লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারে, তা হলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা দান পায়। এভাবে চলতে থাকে গোল্লাছুট খেলা।আর হাডুডু তো জাতীয় খেলা হয়ে জাতীয় ফল কাঠালের মতোই পেকে ফেটে গেছে সেই কবে। ক্রিকেটের মতো সারাদিন আটকে রাখেনা এসব খেলা। সময়ের অপচয়ও হবেনা এতে। অল্পসময়ের মধ্যেই ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়া খেলাগুলো আজ খুব জরুরী ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন যান্ত্রিক নগরে। তা না হলে স্যাটেলাইট বিনোদন খেয়ে নেবে একে একে পা থেকে শিরদাঁড়া।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT