3:48 pm , February 1, 2023
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের কথা অনেকেরই মনে আছে। স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির পরিকল্পনায় ২০২০ সালের ২৬ জুন যাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছিলো সন্ত্রাসীরা। যারা এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের একজন নয়নবন্ড যিনি ওই বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে নিহত হন ক্রসফায়ারে। বাকী আসামীদের মধ্যে মিন্নিসহ ৬ জনের মৃত্যুদন্ড হয়েছে। আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি শুরুতে ছিলেন এই মামলার এক নম্বর সাক্ষী। কিন্তু পুলিশের তদন্তের পর মামলার চার্জশীটে অভিযুক্তের তালিকায় আসে মিন্নির নাম। পরকীয়া প্রেমের জেরে মিন্নির পরিকল্পনায়ই হত্যা করা হয় রিফাত শরীফকে। পুরনো প্রেমিক ও তার সহযোগিকে নিয়ে সোনালী ব্যাংকের গাড়ি চালক স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে স্ত্রীসহ চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বুধবার বেলা ১২ টার দিকে বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ঘটনার শিকার সৌরভ বেপারী (২৮) গৌরনদীর পিঙ্গলাকাঠি গ্রামের কবির বেপারীর ছেলে ও সোনালী ব্যাংকের বাংলামটর শাখার চালক পদে কর্মরত।
সৌরভ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বলে পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম।
উদ্ধার করা হয়েছে সৌরভকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখমের জন্য ব্যবহৃত চাপাতি ও চাকু এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা মোবাইল ফোন সেট।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- তার স্ত্রী একই গ্রামের বাসিন্দা কালাম গাজীর কন্যা রাবেয়া আক্তার মুসকান (১৯), তার প্রেমিক উপজেলার কালনা গ্রামের হাকিম ফকিরের ছেলে আবু সাঈদ সিয়াম ফকির (২২) ও তার সহযোগি জিহাদ হাসান রাজন সিকদার (১৭) ও রায়হান খন্দকার (২৮)।
তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন।
অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া গৌরনদী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হেলালউদ্দিন জানান, গত ২৫ জানুয়ারী সন্ধ্যায় কালনা গ্রামে সৌরভকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। সৌরভকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে।
পরিদর্শক হেলাল জানান, এ ঘটনায় গত ২৮ জানুয়ারি সৌরভের বাবা কবির বেপারী বাদী হয়ে তার পুত্রবধূ রাবেয়াকে প্রধান আসামী করে গৌরনদী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার অন্যান্য আসামীরা হলো-রাবেয়ার প্রেমিক সিয়াম ফকির, তার সহযোগী রাজন সিকদার, রায়হান খন্দকারসহ অজ্ঞাতনামা ২/৩ জন।
পরিদর্শক হেলাল বলেন, ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন ও অজ্ঞাতনামা হামলাকারীদের শনাক্তের জন্য অভিযান ও গোয়েন্দা তথ্য
সংগ্রহ শুরু করে পুলিশ। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী স্ত্রী মুসকানের আচরন সন্দেহজনক হওয়ায় এবং ডিজিটাল তথ্য প্রমান পেয়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে স্ত্রী মুসকান স্বেচ্ছায় স্বীকার করে সৌরভ বেপারীর সাথে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়। সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়সহ মুসকানের পূর্বের বন্ধুবান্ধবের সাথে সম্পর্কের রাখা নিয়ে সৌরভের সাথে দ্বন্দ্ব হয়। এতে মুসকান স্বামী সৌরভের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে প্রেমিক সিয়াম ও রাজনের সহযোগিতায় খুনের পরিকল্পনা করে। গত ২৪ জানুয়ারী সৌরভ ছুটিতে বাড়ী এলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দুপুরের খাবারের সাথে মুসকান ভিটামিন ঔষধ বলে চেতনানাশক ঔষধ সেবন করায়। পরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কেনাকাটা করার জন্য স্বামীকে নিয়ে বের হয়। প্রথমে গৌরনদী উপজেলা সংলগ্ন বিউটি পার্লারের সামনে গিয়ে স্বামী সৌরভের কাছ থেকে নগদ টাকা ও ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিয়ে মুসকান বিউটি পার্লারে প্রবেশ করে। সেখানে মোবাইল ফোনে প্রেমিক সিয়ামকে দিয়ে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পার্লার থেকে বের হয়। পরে গৌরনদী বন্দরে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করার সময় সৌরভ শারীরিক অসুস্থবোধ করে। তখন মুসকান সৌরভকে নিয়ে ইজিবাইকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ার দিকে মুসকান বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা বলে ইজিবাইক থেকে নেমে হেটে রওনা দেয়। তারা কালনা গ্রামের শামসুল হকের বাড়ির পূর্ব পাশে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পিত অনুযায়ী মুসকানের প্রেমিক আবু সিয়াম ও রাজন পিছন দিক থেকে ধারালো চাপাতি ও ছোরা নিয়ে অতর্কিত হামলা করে। তারা সৌরভকে খুন করার উদ্দেশ্যে ধারালো চাপাতি ও চাকু দিয়ে এলোপাথাড়িভাবে কোপাতে শুরু করে। এতে সৌরভের গলার উপরের অংশে, ঘাড়ের নিচের অংশে, গালে, কানে সহ দুই হাতে গুরুতর জখম হয়। তখন মুসকান স্বামীকে বাচানোর চেষ্টা না করে নীরবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। সৌরভের ডাক চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
পরিদর্শক হেলাল জানান, মুসকানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারী টঙ্গী পূর্ব থানার দত্তপাড়া লেদু মোল্লা সড়ক থেকে আবু সাইদ সিয়াম ও জিহাদ হাসান রাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কালনা গ্রামের ঝোপের মধ্যে ফেলে দেয়া চাপাতি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে।
পরিদর্শক হেলাল বলেন, গত ২৮ জানুয়ারী মুসকান বরিশাল জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাকে ও ঘটনার পর গ্রেপ্তার রায়হান খন্দকারকে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে।
বুধবার বিকেলে রাজনকে শিশু আদালতে ও সিয়ামকে বিচারিক হাকিম আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে।
সৌরভের বাবা কবির বেপারী বলেন, মাত্র সাড়ে চার মাস আগে বিয়ে হয়েছে। আমি কখনো ওর শ্বশুরবাড়ির লোকদের বলিনি যে আমার ছেলে সরকারি চাকরি করে। বলেছি গাড়ির ড্রাইভার। আমার ছেলেকে কুপিয়ে হত্যার পরিকল্পনা পুত্রবধূ করেছে তা কেউ বুঝতে পারিনি। তবে যখন আমি আহত ছেলের কাছে যাই তখন পুত্রবধূর আচরণে মনে হয়েছে সে জড়িত থাকতে পারে। তিনি বলেন, আমার নির্দোষ ছেলেকে এভাবে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আমি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।