3:58 pm , January 29, 2023
আরিফ আহমেদ ॥ যানজট ও একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় বরিশালের মহাসড়ক এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। আর নগরীর অভ্যন্তরীণ ছোট সড়ক ও সাইডলেনে ইজিবাইক ও অটোরিকশা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি অসংখ্য যাত্রী। এজন্য ইজিবাইক ও অটোরিকশাকে দায়ী করা হলেও বাস্তবে সড়ক আইন না মানাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে সর্বত্র। এটা স্পষ্ট যে, শুধু ইজিবাইক ও অটোরিকশাই নয়, ট্রাফিক পুলিশের অবহেলা ও সংকটের কারণেও বরিশালের সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও যানজট বাড়ছে বলে দাবী সাধারণ মানুষ ও নগর চিন্তাবিদদের। আর ট্রাফিক বিভাগে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব বলে দাবী সংশ্লিষ্টদের।
সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র অনুসন্ধান ও সরেজমিনে ২৯ জানুয়ারী রবিবার বরিশাল নগরীর রূপাতলী থেকে নথুল্লাবাদ, বাংলাবাজার, নতুনবাজার, সদর রোডের লুকাস মোড়, নগর ভবন হয়ে জিলাস্কুল ও উত্তরের আমানতগঞ্জ, কাশিপুর, রহমতপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টেই কোনো ট্রাফিক পুলিশ বা কনস্টেবল নেই। এমনকি নগর ভবনের সামনে তিনরাস্তার মোড় দুটিও ট্রাফিক পুলিশের জন্য হাহাকার করছে। ৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতায় মোট সড়ক রয়েছে ৫১৩ কিলোমিটার। আর এই সড়কের মধ্যে তিন রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই মোড়গুলো বিপদজনক হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র রূপাতলী, নথুল্লাবাদ, সদর রোডের লুকাস পয়েন্ট ও জেলখানা পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট রয়েছেন। অন্য কোথাও কোনো সার্জেন্ট তো দূরের কথা কোনো কনস্টেবলও নেই। তবে বটতলা চৌরাস্তায় কখনো কখনো ট্রাফিক থাকলেও সেখানে এবং নতুনবাজার পয়েন্টের যানজট এখন স্থায়ী হয়ে গেছে। যা সড়কের পরিধি বৃদ্ধি ছাড়া দূর করা অসম্ভব বলে দাবী ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের। এদিকে সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত নগরীর আমতলা ও আমতলা পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় স্কুল ও অফিসগামী মানুষের ভীড় জমে যায়। এখানে একটি তিন রাস্তা মোড় ও অন্যটি চার রাস্তার মোড় পাশাপাশি হওয়ায় পথচারী ও ছোট যানবাহনের জন্য মহাবিপদজনক হয়ে উঠেছে। সকালে এখানে অল্পের জন্য বাসচাপা হতে বেঁচে গেছে দুজন স্কুলগামী শিশু ও তাদের মা। অথচ এখানে পুলিশ কমিশনার কার্যালয় ছাড়াও তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মেহেদী পারভেজ আবীরের কার্যালয়। তিনি বলেন, এই পয়েন্ট দুটিতে দুজন ট্রাফিক কনস্টেবল থাকার কথা। গত কিছুদিন ধরে তাদের কাউকে দেখছি না। এখানে এলাকাবাসীর সুবিধার্থে একটি ফুটওভারব্রীজ এখন খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। আমি মেয়র মহোদয়কে এ বিষয়ে অবগত করেছি।
কাউন্সিলর আবীর আরো বলেন, আমি প্রথমবার নির্বাচিত হয়েই ট্রাফিক বিভাগের কাছে আবেদন করে আমতলা মোড়ের চৌরাস্তার জন্য ট্রাফিক পুলিশ এনেছিলাম। এখন কেন নেই তা খোঁজ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে আবারও আবেদন করবো।
নগর চিন্তাবিদ ও বরিশাল অর্থনীতি সমিতির সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ১৫ থেকে ২০টি তিন রাস্তার মোড় ও চার-পাঁচটি চৌরাস্তা বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায়। ট্রাফিক সার্জেন্ট না দিতে পারলেও কনস্টেবল নিয়মিত করা খুব কঠিন নয়। তবে যত যাই বলি পরিকল্পিত নগরায়ণ ঘটাতে হবে। সিটি করপোরেশনের এলাকার পরিধি বাড়াতে হবে। তা না হলে এই সংকট কাটবে না। সবচেয়ে জরুরী বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা। তা না হলে এ সংকট কাটবেনা বলে জানান কাজী মিজান।
পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, নগরীর ৩৫/৪০টি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম থাকার কথা। সেখানে হাতেগোনা চার পাঁচটি পয়েন্টে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে, ট্রাফিক বিভাগেরও ডিজিটাল হওয়া জরুরী। তারা ড্রোনের মাধ্যমে যানজট প্রবল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তবে তিন ও চার রাস্তার মোড়গুলোতে স্থায়ী ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রণ জোন তৈরি জরুরী। বিশেষ করে আমতলার মোড়, জিলাস্কুল মোড়, চৌমাথা, বটতলা ও চকবাজারের ফলপট্টি মোড় বিপদজনক। এসব স্থানে সার্বক্ষনিক ট্রাফিক পুলিশ থাকা জরুরী বলে মনে করেন শিবলু।
নগরীর ৩১/৩২ টি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ থাকা জরুরী স্বীকার করে ট্রাফিক সার্জেন্ট শাহিন বললেন, কনস্টেবলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও মোড়গুলোতে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। কম হলেও তিনজন প্রয়োজন। বরিশালে রয়েছে মাত্র ৭৯জন কনস্টেবল। ৩৬টি পদ এখনো শূন্য আছে। একই দশা ট্রাফিক সার্জেন্টদেরও। ৩৭ জনের কাজ করছি আমরা সবমিলিয়ে ২৭ জন সার্জেন্ট।
উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) এস এম তানভীর আরাফাত বললেন, নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন একশিফটে ৩৫/৩৬ জন কনস্টেবল কাজ করছেন। ১১ জন মাত্র সার্জেন্ট কতদিক সামলাতে পারে আপনারাই বলুন। তবুও নথুল্লাবাদ, রূপাতলী, লুকাস পয়েন্টে তিন থেকে চারজন করে কনস্টেবল ও দুজন করে সার্জেন্ট রাখতে হচ্ছে। ডিসি অফিস, পুলিশ কমিশনার কার্যালয় ও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে একজন করে চলে গেলে থাকে কতজন? এতো অল্প লোকবল নিয়ে ৩২টি পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। আমতলার মোড়ে একজন সার্জেন্ট নিয়মিত থাকেন উল্লেখ করে ট্রাফিক বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু কনস্টেবল রেখে লাভ নেই। কারণ সেতো মামলা দিতে পারেন না। আমাদের লোকবল সংকটের কারণে সব পয়েন্টে ট্রাফিক কনস্টেবল রাখা আসলে সম্ভবও হচ্ছেনা। এদিকে নগরীতে ইজিবাইক ও অটোরিকশা যে হারে বাড়ছে তাও বিপদজনক। আবার পদ্মা সেতুর কারণে বহিরাগত গাড়ির চাপও ক্রমশ বেড়েই চলছে। সড়কের পরিধি বৃদ্ধি, ভবনগুলোতে গাড়ি পার্কিং এগুলো সিটি করপোরেশনের কাজ। আমরা যানজট ও দুর্ঘটনা নিরসনের জন্য বেশকিছু প্রস্তাবনা তাদের দিয়েছি। নগরীর যানজট ও দুর্ঘটনা এড়াতে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও আন্তরিকতা আগে প্রয়োজন বলে জানান তানভীর আরাফাত।