3:21 pm , January 23, 2023

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নথুল্লাবাদ থেকে রুপাতলি যানজটে অস্থির বরিশাল নগরী। যতদূর চোখ যায়, শুধু ইজিবাইক ও অটোরিকশার দীর্ঘ সারি। কোনো গাড়িতে শ্রমিক সংস্থা আবার কোনো গাড়িতে শ্রমিক কল্যাণ সমিতির স্টিকার লাগিয়ে চলছে যাত্রী টানার প্রতিযোগিতা। ফলে যত্রতত্র ব্রেক করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণে সড়কে তৈরি হচ্ছে যানজট। সাধারণ মানুষের অভিযোগ দুটি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিযোগিতার সুযোগে ও সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স দেয়ার প্রলোভনে গত এক সপ্তাহে হাজারখানেক ব্যাটারি চালিত যানবাহন বেড়েছে সিটি করপোরেশন এলাকায়। আর এসব চালকদের বেশিরভাগই অদক্ষ হবার কারণে নগরীতে দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে দাবী তাদের। অন্যদিকে ব্যবহার অনুপযোগী সব সাইডলেন ও সংযোগ সড়কের কারণেও বরিশাল নগরীর মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও যানজট বাড়ছে বলে মনে করেন নগর চিন্তাবিদদের অনেকে।
২৩ জানুয়ারী সোমবার রূপাতলী থেকে সাগরদি ব্রীজ পর্যন্ত এবং নতুন বাজার থেকে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় ভয়ংকর যানজটের চিত্র দেখা গেছে। নতুন বাজার থেকে নথুল্লাবাদ গামী সড়কে হাজারো ইজিবাইক ও অটোরিকশার দীর্ঘ লাইন। বাস টার্মিনালের সামনে ট্রাফিক পোস্টে দাঁড়ানো সার্জেন্ট জানালেন, সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স দেয়ার ঘোষণার পর থেকে নগরীতে ইজিবাইকের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। সামনে অবস্থা আরো খারাপ হবার আশংকা করেন তিনি।
নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় যানজটের অন্যতম কারণ ইজিবাইক ও থ্রি হুইলার দাবী করে বাস চালক মনির হোসেন ও সামছু মিয়া বলেন, অটোরিকশা, ইজিবাইক ও মাহেন্দ্র এতোবেশি বেড়েছে যে ওদের জন্য রাস্তায় চলা যায়না। তবে মাহেন্দ্র চালক মোকলেছুর রহমান বললেন, যানজটের জন্য আমরাই শুধু দায়ী নই। সবাই কমবেশি দায়ী। পদ্মা সেতুর কারণে সড়কে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সেই তুলনায় রাস্তা বাড়েনি। এই সড়ক দ্রুত ফোরলেন হওয়া জরুরী। একইসাথে রুপাতলী ও নথুল্লাবাদ টার্মিনাল শহরের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন এই তিন চালক। যদিও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চাকলাদার পরিবহনের বাস চালক সামছু মিয়া বলেন, যতদিন নথুল্লাবাদ টার্মিনাল অন্যত্র স্থানান্তর করা না যাবে ততদিন এই টার্মিনালের পিছনের দিকে আরেকটু বাড়িয়ে গাড়ি যেন ভিতরেই ঘুরিয়ে বের করা যায় সেটা নিশ্চিত করা গেলে সড়কে যানজট কমবে। তবে তার আগে ইজিবাইক ও অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এদের বেশিরভাগই অদক্ষ চালক। সড়কের নিয়মনীতি না জেনেই রাস্তায় নেমে পড়েছে এরা। এদের নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরী।
বিষয়টির সাথে একমত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে। তিনি বলেন, গরিয়াপাড়ে বাস টার্মিনাল স্থানান্তর করার কথাবার্তা চলছে। তবে তা কতদিনে সম্ভব হবে জানা নেই। আরো কিছু জমি অধিগ্রহণ করে এই টার্মিনালের পরিধি বাড়ানো জরুরী। কারণ আগের তুলনায় পরিবহনের চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে আমি বলবো তারপরও সড়কের প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। বিকল্প সড়কের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একইসাথে ইজিবাইক ও অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ জরুরী। এদের প্রশিক্ষণ জরুরী বলে দাবী করেন কিশোর কুমার দে।
নথুল্লাবাদ এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট রানা বলেন, এই যানজট নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এরা কেউ কথাতো শোনেইনা উল্টো রাস্তার মধ্যে গাড়ি রেখে তর্ক করে। আবার জায়গা এতো কম যে একটা বাস টার্মিনালের ভিতর থেকে বের হতেই যানজট তৈরি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, নথুল্লাবাদ ও রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আর গত তিনদিনের মধ্যে নগরীর ইজিবাইক ও অটোরিকশা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এতোটা যে আমারতো মনে হয় তিন চার গুণ বেড়েছে।
নগর চিন্তাবিদদের একজন বরিশাল অর্থনীতি সমিতির সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, হলুদ ইজিবাইকগুলো থাকুক। সাধারণ মানুষের জন্য এগুলো খুবই উপকারী। কিন্তু অটোরিকশাগুলো তুলে দেয়া ও শহরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা জরুরী। কেননা এগুলোর কারণে অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন। তবে ইজিবাইক চালকদের প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কাজী মিজানুর রহমান বলেন, নগরীতে মনীষা চক্রবর্তী ও পরিমল দাস সমর্থিত দুটি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিযোগিতা চলছে। এরফলে অবৈধ রিকশার সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, মহাসড়কে রূপাতলী থেকে নথুল্লাবাদ চলাচলকারী ক্ষুদে যানবাহনগুলোকে সাইডলেন ব্যবহারে বাধ্য করা উচিত। তাহলে মহাসড়কে দুর্ঘটনা কিছুটা কমতে পারে।
তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় নগরীর আমতলা মোড় থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত ঘুরে। এখানে দেখা গেলো ইজিবাইক, অটোরিকশা বা সিএনজি সাইডলেন ব্যবহার করছেনা। তাদের কয়েকজনকে থামিয়ে সাইডলেন ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে বলেন, একটি রাস্তাও তো ভালো নেই। কিভাবে এই রাস্তায় চলবো বলেন? আগে রাস্তা ঠিক করে দেন, সংযোগ সড়ক ঠিক করে দেন। ঘুরে তো আবার সেই মহাসড়কেই উঠতে হয়।
এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রিক্সা ভ্যান ইজিবাইক ও অটোরিকশা শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি পরিমল দাস জানান, এইতো সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বাছাই চূড়ান্ত হলেই শুধু লাইসেন্স প্রাপ্ত ইজিবাইক নগরীতে চলবে। আগে ২৬শটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন আরো হয়ত তিনহাজার সর্বোচ্চ অনুমোদন হতে পারে বলে জানান পরিমল।
আর বিষয়টি প্রতারণা দাবী করে রিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা-ভ্যান-ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদের বরিশালের সভাপতি দুলাল মল্লিক বলেন, আমাদের সমাবেশ ঠেকাতে সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দেয়ার প্রলোভন দিয়েছে। ওটা আগামী ছয়মাসেও হয় কিনা দেখুন। তিনি বলেন, ইজিবাইক ও অটোরিকশা বাড়ছে সিটি করপোরেশনের অদক্ষতার কারণে।
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা আগেই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এখন সবটাই সিটি করপোরেশনের ইচ্ছা ও আন্তরিকতার উপর নির্ভরশীল বলে জানালেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি)’র উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) এস এম তানভীর আরাফাত।