3:21 pm , November 14, 2022
প্রকৃতির ভয়াবহ ধ্বংসলীলা সিডর’র কাল রাত্রী আজ
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ‘সিডর’এর কালরাত্রী আজ। ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ দেশের উপকুলের ১০টি জেলায় আছড়ে পড়ায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। যা ছিল সে সময়ের এক বছরের এডিপি’র প্রায় সমান। সরকারী হিসেবেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১৬ হাজার কোটি টাকা বলে তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার স্বীকার করেছিল। প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতার কারণে প্রানহানীর সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হলেও প্রায় ৩ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেয় ভয়াল সিডর। ঝড়ের জলোচ্ছাসে আরো সহ¯্রাধীক আদম সন্তান নিখোঁজ হলেও তাদের প্রায় কারোরই আর কোন সন্ধান মেলেনি। সেদিনের ঐ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকুলীয় ও দক্ষিনাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারী হিসেবেই ক্ষতিগস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও তা ছিল কমপক্ষে ২০ লাখ। আর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৫ লাখেরও বেশী। সরকারীভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও এক হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজের কথা বলা হলেও এ সংখ্যাও ছিল আরো অনেক বেশী। সিডরের বয়ে আনা জলোচ্ছাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বেশীরভাগ নিখোঁজদের আর কোন সন্ধান মেলেনি। ফলে স্বজনেরা ঐসব নিকটজনের লাশটিও আর দেখতে পায়নি।
সিডরের ঐ তান্ডবে দক্ষিন উপকুলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টরের আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের রাতে প্রকৃতির কালো থাবায়। তবে পরিবেশবিদদের মতে, সেদিন সিডরের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ হত যদি উপকুলীয় বিশাল সবুজ বেষ্টনীর বনায়ন না থাকত। সিডরের কাল রাত্রীতে প্রকৃতির ভয়াবহ তান্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিহত করেছিল উপকুলীয় ঐ বনভুমি। আর ভয়াল ঐ তান্ডব সামাল দিতে সে রাতে উপকুলীয় বনায়ন ও সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের লক্ষ লক্ষ গাছ ছাড়াও সাধারন মানুষেরও প্রায় ১ কোটি গাছ মাটিতে মিশে গিয়েছিল ।
এছাড়াও কয়েকশ কিলোমিটার উপকুলীয় ও নদী তীরবর্তি বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ এবং প্রায় পৌনে ৭শ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামোর প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক এবং বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের আড়াই হাজার সেতু ছাড়াও কালভার্ট সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকার প্রায় ২ হাজার সরকারীÑবেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড় ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
ঝড়টির ব্যাস মাত্র দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও দৈর্ঘ ছিল যথেষ্ট লম্বা। সাগর পাড়ের হরিণঘাটাÑপাথরঘাটা থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দুরে বরিশাল পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান তীব্রতায় সিডরের নারকীয় তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি খোদ নগরীতেও ঘূর্ণিঝড়টি প্রায় সোয়া ২শ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগের ঝড়টির সাথে প্রায় ১৫Ñ২০ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপকুলের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমিকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
সিডরের তান্ডবের পর দিনই সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত ত্রান তৎপরতা শুরু করলেও পরবর্তিতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রান ও পূণর্বাসন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়। তবে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও তার মধ্যে ৩২টি দেশ পরবর্তিতে তা বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রনব মুখার্জীও বরিশাল বিমান বন্দর হয়ে শরনখোলার ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সফরকালে সেখানের কয়েকটি গ্রামের দূর্গতদের ঘরবাড়ী নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয় প্রায় ৫ বছর পরে।
ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় পাক সরকার তাদের বিমান ও সেনা বাহিনী পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করছিল। পাক বিমান বাহিনীর ৪টি ‘সি-১১০’ পরিবহন বিমান দু দফায় বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে অবতরন করে। দুটি মোবাইল হাসপাতাল সহ পাক সম্মিলিত বাহিনী সেদিন পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া ও ভান্ডারিয়াতে চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রমে অংশ নেয়। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহেও পাক সেনা সদস্যরা অংশ গ্রহণ করেছিল।
মার্কিন মেরিন সেনারাও ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকুলীয় এলাকাতে পানি সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল। বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করে সেদিন ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকুলীয় এলাকায় ত্রান ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালিত হয়।
আবহাওয়া অধিদফতর ২০০৭-এর ১১ নভম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিন বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ শনাক্ত করে। যা ক্রমশ উত্তরÑপশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আন্দামান নিকোবরকে ডানে রেখে এগুতে থাকে। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় লঘুচাপটি আন্দামান থেকে সোজা উত্তরে এগুতো থাকে। লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বাংলাদেশÑভারত সীমান্ত উপকুল বরাবর এগুতে থাকে। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় সিডর ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গলÑহাড়িয়াভাঙ্গা উপকুল সোজা অগ্রসর হচ্ছিল। ১৫ নভেম্বর বিকেলে ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিনÑপশ্চিম উপকুলের মাত্র ১শ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে।
কিন্তু ঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকুলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে ধরে নেয়া হলেও আকষ্মিকভাবে গতিপথ উত্তরÑপূর্বমুখি হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পরেই সিডর দ্রুত গতিতে দেশের দক্ষিন-পশ্চিম সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তি হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর সাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখন্ডে আছড়ে পরেছিল। ভয়াল সিডর-এর কালো রাত্রির দূর্যোগ গোটা উপকুলবাসীকে আজো তাড়া করে ফিরছে।