2:50 pm , November 9, 2022

ম. জাভেদ ইকবাল :
সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ আট কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন । নারীর সংখ্যা আট কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ হাজার ৬২৯ জন। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। বিশাল এই নারী জনগোষ্ঠীকে আমরা যদি পিছনে ফেলে দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তাহলে সেটা হবে বোকার ভাবনা। এই বিশাল নারী জনগোষ্ঠীকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে তার জন্য সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নারীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়টি নানা কর্মসূচি নিয়ে এ লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। নারীকে সচেতন ও স্বাবলম্বী করে তোলাই এই কর্মসূচিসমূহের উদ্দেশ্য। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রালয়ের অধীন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে নারী উন্নয়নে গৃহীত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও কার্যক্রমের সমন্বয় করা হয়। নারীবান্ধব আবাসিক-অনাবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বৃত্তিমূলক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে যাচ্ছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। ভিডব্লিউবি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকারের সর্ববৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে দুঃস্থ ও অসহায় এবং শারীরিকভাবে অক্ষম মহিলাদের উন্নয়ন স্থায়ীত্বের জন্য দুই বছর ব্যাপী একজন নারী প্রতি মাসে ৩০ কেজি খাদ্যশস্য ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। দরিদ্র মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থায় উন্নত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘দরিদ্র মা’র জন্য মাতৃত্বকাল ভাতা দেয়া হয়। বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিত্তহীন ও দরিদ্র মহিলাদের উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা হয়। এর ফলে নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। ১৯৮৬ সাল থেকে নির্যাতনের শিকার নারীদের আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে এক জন আইন কর্মকর্তার সমন্বয়ে চারটি পদ নিয়ে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু হয় যা পরবর্তীতে জেলা ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসহ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি গঠন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়েও নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টোরাল প্রোগ্রামের অধীনে সাতটি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। ওসিসি হতে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা, আইনি সহায়তা, পুলিশি সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা, মানসিক কাউন্সেলিং, আশ্রয় এবং সমাজের পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা প্রদান করা হয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টোরাল কার্যক্রমের মাধ্যমে হেল্পলাইনের ১০৯ নাম্বারে (টোল ফ্রি) ফোন করলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনী সহায়তা প্রদান করা হয়। যেকোন মোবাইল হতে ২৪ ঘণ্টা এই নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু তাদের পরিবারের সদস্যসহ যে কেউ প্রয়োজনীয় সাহায্য পেতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সংগঠনসমূহের নিবন্ধন প্রদান ও তদারকিসহ তাদের মধ্যে বাৎসরিক অনুদান প্রদান করে যাচ্ছে মহিলা বিষয়ক অফিসগুলো। গ্রামীণ দুঃস্থ মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন ট্রেডে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এটা দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত বেকার মহিলাদের আয়বর্ধক হিসেবে সহায়ক। চাকুরি, বিনিয়োগ তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে নিবন্ধিকৃত বেকার, শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত কিংবা অদক্ষ চাকুরি প্রত্যাশী নারীদের চাকুরি সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ, চাকুরি প্রাপ্তিতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও অগ্রাধিকার প্রাপ্তিতে সহায়তা করে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র সংগঠনের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা, বিপণন ও বাজারজাতকরণে সহায়তায় নারীবান্ধব উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রয়াস- জয়িতা এবং অঙ্গনা পরিচালিত হচ্ছে। শহর এলাকার দরিদ্র কর্মজীবী দুগ্ধদায়ী মা এবং তাঁদের শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে সার্বিক জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও কর্মজীবী উপকারভোগী দরিদ্র মা’দেরকে দুই বছর ব্যাপী প্রতিমাসে পাঁচশত টাকা করে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। কর্মজীবী নারীদের নিরাপদ আবাসন সুবিধা প্রদানের জন্য সারাদেশে সাতটি মহিলা হোষ্টেল পরিচালনা করা হচ্ছে। কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য ঢাকাসহ সকল বিভাগীয় শহরে দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। মহিলা, শিশু ও কিশোরী হেফাজতীদের নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি সকল প্রকার শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা এবং আইনগত সহায়তা সেবা প্রদান করা হয়। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সকল কার্যক্রম ই-সার্ভিস কর্মসূচরি আওতায় নিয়ে আসা এবং সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যক্রম ই-সার্ভিসের আওতাভূক্তকরণ কর্মসূচি নামে একটি কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহিলা সহায়তা কর্মসূচির অধীনে নির্যাতনের শিকার, অসহায়, দুঃস্থ নারীদের আইনী সহায়তা প্রদানের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল এবং নির্যাতিত নারীদের সাময়িক অবস্থানের জন্য আবাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। প্রতিরোধ সেলে নির্যাতনের শিকার নারীদের অভিযোগ গ্রহণ, কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি, দেনমোহর, স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, খোরপোষ ও সন্তানের ভরণ-পোষণ আদায় করা হয়। এছাড়াও ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসূচি চলমান যেখানে তৃনমুল পর্যায়ের নারীদের জীবনগাঁথাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সকল বিভাগীয় পর্যায়ে নারীদের তিন মাস ব্যাপী মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সেচ্ছাসেবী মহিলা সংগঠন তৈরি ও পরিচালনা করা হয়। ডিএনএ অধিদপ্তর চালু করা হয়েছে। সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সর্বোপরি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ এবং বাল্যবিবাহমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের এ সকল কর্মসূচি নারীর অধিকার আদায়ে বলিষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছে। পিছিয়ে পড়া নারীরা এসকল সুযোগ ও সুবিধাগুলো গ্রহণ করে নিজের পায়ে যেমন দাঁড়াতে পারবে তেমনি তারা তাদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হবে।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, বরিশাল। সেল: ০১৭৮৫ ৭৯৭৮৭১।