দক্ষিণাঞ্চলে ২৭ লাখ বেল পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা ॥ দর পতনে ক্ষতির মুখে কৃষকরা দক্ষিণাঞ্চলে ২৭ লাখ বেল পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা ॥ দর পতনে ক্ষতির মুখে কৃষকরা - ajkerparibartan.com
দক্ষিণাঞ্চলে ২৭ লাখ বেল পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা ॥ দর পতনে ক্ষতির মুখে কৃষকরা

3:32 pm , August 26, 2022

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দক্ষিণাঞ্চলে এবারো প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে ২৭ লাখ বেল পাট উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে কৃষি অর্থনীতি আরো এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে বৃষ্টির অভাবে পাম্প মেশিন দিয়ে বিকল্প উৎস্য থেকে পানি সংগ্রহ করে জাগ দিতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি পাটের রং কিছুটা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়ার সুযোগে ফড়িয়ার দল দাম কমিয়ে দেয়ায় কৃষকের মাথায় হাত। পাটের এ অঞ্চলে সরকারী কোন পাটকল না থাকলেও বৃহত্তম বেসরকারী পাট কলসহ সারা দেশের বেসরকারী পাটকল গুলো কাঁচা পাট কেনায় গত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে পাটের যে স্বর্ণ যুগ চলছিল, এবার তাতে ছন্দ পতন ঘটছে। গত বছরও দক্ষিণাঞ্চলে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা মন দরে পাট বিক্রি হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছিল। কিন্তু এবার সেখানে দর পতনে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় পাট বিক্রি হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম কানাইপুর, সদরপুর,পুকুরিয়া সহ বড় মোকামগুলোতে।
২০২০Ñ২১ অর্থ বছরে দেশে ৭৭.২৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হলেও গত অর্থবছরে উৎপাদন ছিল প্রায় ৮৫ লাখ বেল। সেখানে চলতি অর্থ বছরে ৭ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার ১.১০% অতিরিক্ত ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭৮ হেক্টরে পাটের আবাদ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই’র মতে, এবার উৎপাদন লক্ষ্য রয়েছে ৮৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ বেল। তবে কয়েকটি এলাকায় পাট বণ্যা কবলিত হবার পাশাপাশি কিছু এলাকায় বৃষ্টির অভাবে পানি সংকটে সময়মত জাগ দেয়া নিয়ে সংকট চলছে। তবে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় প্রায় ৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদনের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন দায়িত্বশীল সূত্র। এবার শুরু থেকে আবহাওয়া পাটের জন্য মোটামুটি অনুকুল থাকায় হেক্টর প্রতি উৎপাদন ১১.৫০ টন পর্যন্ত আশা করছেন কৃষিবিদরা।
তবে ভরা আষাঢ়Ñশ্রাবনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের ফলে পাট জাগ দেয়া নিয়ে কিছু এলাকায় সংকট তৈরী হলেও কৃষকগন পাম্প মেশিনের সাহায্যে বিকল্প উৎস্য থেকে পানি সংগ্রহ করেছেন। উপরন্তু সংকটের এ সময়টিতেই ডিজেলের দামও বেড়ে যায়। ফলে এবার পাটের উৎপাদন ব্যয় ২ হাজার টাকার ওপরে উঠে গেছে বলে কৃষকগন জানিয়েছেন। কিন্তু জাগ দেয়ার সংকটেই এবার দক্ষিণাঞ্চলে পাটের সোনালী রঙ কিছুটা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া দর পতনও ঘটেছে। গত বছর সারা দেশের মত এ অঞ্চলের কৃষকরা প্রতিমন পাটের দাম সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত পেলেও এবার তা আড়াই হাজার টাকার বেশী নয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় তুলে আনাই সম্ভব হচ্ছে না।
ডিএই’র মতে সারা দেশের প্রায় ৩০% পাটের আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব জেলাতেই পাটের আবাদ এবারো আগের বছরের প্রায় সমান পর্যায়ে থাকলেও তা সম্প্রসারনের যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করছে পাট গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর দায়িত্বশীল মহল। এ লক্ষ্যে ডিএই’র পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে নিবিড় কর্মসূচী গ্রহন ও বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেয়া হয়েছে। তবে পটুয়াখালী, ভোলা ও ঝালকাঠীতে আবাদকৃত পাট এখনো অনেকটা সবজী হিসেবেই বিক্রি করে কৃষকরা আগাম অর্থ ঘরে তুলছেন।
২০২০-এ করোনা সংকটের মধ্যে সরকারী পটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ায় পাট নিয়ে কৃষকদের দুঃশ্চিন্তা বাড়লেও তারা দমে থাকেননি। ধানের চেয়ে বেশী দাম পাবার আশায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা গত কয়েকটি বছর পাট চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তবে প্রতিমন পাটের উৎপাদন ব্যয় প্রায় দু হাজার টাকার ওপরে হলেও ২০২০ সালে পাট বিক্রি হয়েছিল ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের পাট চাষিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তারা হতাশ হয়ে দমে থাকেনি। গত বছর দেশে ৭ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টরে পাট আবাদ হলেও তা আগের বছরের তুলনায় বেশী ছিল। এরমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলেই আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টরে। গত মৌসুমে পাটের ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকে মুখে হাসিও ফুটেছিল।
চলতি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় ২ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টরে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় পুরোটাই অর্জিত হয়েছে। পাট গবেষনা ইনষ্টিটিউট ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ উপযোগী নোনা পানি সহিষ্ণু পাটের জাতও উদ্ভাবন করেছে। ইনষ্টিটিউট ইতোমধ্যে নাবী জাতের পাটবীজ উদ্ভাবন করেছে। যা আমদানীকৃত বীজের চেয়ে উন্নতমানের ও উচ্চ ফলনশীল। আগামীতে এ পাট বীজই দেশের মোট আবাদকৃত এলাকার চাহিদা মেটাবে বলেও পাট গবেষনা ইনষ্টিটিউট জানিয়েছে। তবে এসব বীজ দক্ষিণাঞ্চলে পাট আবাদে যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তা কাজে লাগাতে পাট গবেষনা ইনস্টিউিট-এর পাশাপাশি ডিএই’র মাঠ কর্মীদের যথেষ্ঠ ভুমিকা রয়েছে।
চলতি মৌসুমে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৮৫ ভাগ পাট কর্তন সম্পন্ন হয়েছে। আমন ও বোরো ধানের পরে পাট দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি অর্থনীতির বড় যোগানদার হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে কোন সরকারী পাটকল না থাকলেও বেসরকারী খাতের ছোট-বড় ২৪টি পাটকলের সচল রয়েছে মাত্র ১৩টি। এরমধ্যে বরিশালের ছোট ও মাঝারি মাপের ৫টি পাটকলের সবই বন্ধ। চলতি মূলধন আর আধুনিক মেশিনারীর সাথে ব্যাংকের দেনায় এসব পাটকল অদূর ভবিষ্যতে আর চালুর সম্ভাবনা নেই বলেই জানিয়েছে একাধিক সূত্র। বেসরকারী খাতে দেশের অন্যতম বৃহৎ করিম জুট মিল ও পারটেক্স গ্রুপের পাটকলও দক্ষিণাঞ্চলেই। কৃষি মন্ত্রনালয়ের হিসেবে দেশে পাট চাষির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ হলেও এখাতের ওপর নির্ভিরশীল প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর জিডিপি’তে পাটের অবদান ০.২৬% হলেও কৃষি সেক্টরে একক অবদান প্রায় ১.১৫%। দেশে উৎপাদিত পাটের ৫১% এখনো স্থানীয় পাটকলে ব্যবহৃত হলেও ৪৪% কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি আয় প্রায় ১শ কোটি ডলারের কাছে। তবে আগের কয়েকটি বছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও গত অর্থ বছরে তা কিছুটা নেতিবাচক ধারায় ছিল। পাটখাতের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসছে পাটসুতা থেকে। কাঁচাপাট ও পাটজাত পন্য ছাড়াও পাটের বস্তা ও চট রপ্তানি হচ্ছে। তবে পাট খাতে সার্বিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৫Ñ৩০%। দীর্ঘদিন পরে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে পাটজাত পণ্য রপ্তানি চামড়াজাত পণ্যকে ছাড়িয়ে গেলেও ২০২০Ñ২১’এ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। এছাড়া পাটখড়ির ছাই ‘চারকল’ ও গত কয়েকটি বছর ধরে চীন সহ বিশে^র কয়েকটি দেশে ভাল বাজার তৈরী করেছে। তবে সম্প্রতি চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে অগ্নিকান্ডের পরে শিপিং কোম্পানীগুলো চারকল বোঝাই কন্টেইনার জাহাজীকরন না করায় সম্ভাবনার এ পণ্য রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ইতোপূর্বে বছরে প্রায় ৩০ কোটি ডলারের চারকল রপ্তানি হতো।
পরিবশেবিদদের মতে, পাটের আবাদ বাড়লে গ্রাম অঞ্চলের জ¦ালানি চাহিদার বড় অংশই মেটান সম্ভব পাটখড়ি দিয়ে। পাট উৎপাদন এলাকার বড় জনগোষ্ঠী জ¦ালানী হিসেবে পাটখড়ি ব্যবহার করে থাকে। ফলে ঐসব এলাকার গাছপালা কাটার প্রবনতাও অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে থাকে। এছাড়া পাটখড়ি থেকে ‘পারটেক্স বোর্ডও তৈরী হচ্ছে দেশে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT