3:30 pm , August 7, 2022
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ করোনা মহামারী সংকটের দুটি মৌসুম পেরিয়ে এবার আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা চাষিদের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করেছে। গত দুটি মৌসুুমে দাম না পাবার কষ্ট আর ক্ষতি এবার অনেকটাই কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি পেয়ারা বাগানকে ঘিরে ভিমরুলীর ভাসমান হাটও জমে উঠেছে। আর এ পেয়ারা হাটসহ বাগান দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। ফলে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান আর ভিমরুলীর ভাসমান হাটকে ঘিরে এলাকার আর্থÑসামাজিক অবস্থার পালেও কিছুটা হাওয়া লেগেছে।
‘প্রাচ্যের ভেনিস’ খ্যাত ঝালকাঠি-পিরোজপুর সীমান্তের ভিমরুলী’র ভাসমান হাটে এবার ভাল দাম পেয়ে পেয়ারা উৎপাদকদের মুখ অনেকটাই উজ্জল। ২০২০-এ করোনা সংকটের প্রথম বছর এ হাটে যেমনি ক্রেতা ছিল না, তেমনি দামও মেলনি। গত বছর দাম কিছুটা বাড়লেও ক্রেতার অভাবে অনেক পেয়ারা বাগানেই নষ্ট হয়েছে। তবে এবার ক্রেতার সমাগমের সাথে দাম ভাল মেলায় কৃষকরা কিছুটা আশায় বুক বেঁেধছেন।
আর এ পেয়ারা বাগানসহ ভিমরুলীর ভাসমান বাজার দেখতে রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটকের ভীড় বাড়ছে। নৌ-পথে ও সড়ক পথে সকাল ১১টার মধ্যে বরিশালে পৌঁছে পর্যটগন ছুটে আসছেন ভিমরুলীর ভাসমান হাটে। সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে বরিশালে ফিরে কেউ আবার সড়ক পথেই ঢাকা ফিরে যান। আবার অনেকেই নগরী ও আশে পাশের এলাকা ঘুরে রাতের লঞ্চে ঢাকায় ফেরেন। অনেকে বরিশালে রাত কাটিয়ে পরদিন দূর্গাসাগর দিঘি ও গুঠিয়ার বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও শের এ বাংলা জাদুঘর দেখে রাতে ঢাকায় ফেরেন।
আটঘরÑকুড়িআনা এলাকার ‘মুকুন্দপুরী’, ‘লতা’ ও ‘পুর্নম-ল’ জাতের পেয়ারা মিষ্টি ও অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। শ্রাবণÑভাদ্র থেকে আশি^নের মধ্যভাগ পর্যন্ত বরিশালÑঝালকাঠি ও পিরোজপুরের ব্রান্ডিং পণ্য পেয়ারা’র ভরা মৌসুম। ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের আটঘর, শতদশকাঠি, কাফুরকাঠি, ভীমরুলি, জিন্দাকাঠি, ডুমরিয়া, খাজুরিয়া, বাউকাঠি, বেতরা, হিমানন্দকাঠি, পোষন্ডা, রমজানকাঠি, সাওরাকাঠি ও কাঁচাবালিয়া সহ বানরীপাড়ার বেশ কিছু গ্রামে প্রতিবছরই প্রায় ১০Ñ১৫ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন হচ্ছে। তবে বিগত দুটি মৌসুমে এসব এলাকার চাষীরা বাগানে ১৫ টাকা কেজি দরেও পেয়ারা বিক্রি করতে না পেরে চরম সংকটে পড়েন। এবার পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ১০ টাকা।
প্রতিদিন এসব এলাকার বাগান থেকে ছোট ও মাঝারী নৌকায় করে বিপুল পরিমান পেয়ারা ভিমরুলীর ভাসমান হাটে নিয়ে আসছে চাষী সহ বাগান পর্যায়ের ক্রেতারা। সেখান থেকে পাইকার সহ খুচরা ব্যবসায়ীরা পেয়ারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। ট্রলার ছাড়াও লঞ্চ, বাস ও ট্রাকে করে ভিমরুলী থেকে পেয়ারা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বাজার ও মোকামে। আটঘরÑকুড়িআনার এ পেয়ারা দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইতোমধ্যে প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গের বাজারেও বিক্রি হচ্ছে। এমনকি এ অঞ্চলের পেয়ারার সাথে আমড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরার আগরতলাতেও ভাল বাজার তৈরী করে নিয়েছে ইতোমধ্যে।
আটঘর-কুড়িয়ানায় এখন পোয়ারার সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন প্রজাতির লেবু ছাড়াও আমড়ার আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে। দেশের সিংহভাগ আমড়ার উৎপাদন হচ্ছে ঝালকাঠী সদর, বানারীপাড়া এবং পিরোজপুরের নেছারাবাদ, নাজিরপুর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।
এলাকায় অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে মাটি কেটে লম্বা ঢিবি তৈরী করে ‘সার্জন’ পদ্ধতিতে পেয়ারার সাথে লেবু ও আমড়ার আবাদ হয়ে আসছে। কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারী উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিতে বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজির আবাদের সম্প্রসারন ঘটছে। ফলে এসব এলাকার কৃষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত।
ভিমরুলি’র ভাসমান হাট থেকে সারা দেশের পাইকাররা পেয়ারা কিনে সড়ক ও নৌ পথে নিজ নিজ মোকামে নিয়ে বিক্রি করছেন। গত প্রায় তিনমাস ধরে ভীমরুলী ও আটঘরÑকুড়িয়ানার ভাসমান বাজারে পেয়ারা চাষি ও পাইকারদের ভিড় লেগে আছে। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, নোয়াখালী ও ফরিদপুর সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বেপারীরা নৌকা থেকেই পেয়ারা কিনে সড়ক ও নৌ পথে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। প্রতিদিন সকালে ভরপুর এ বাজারে পেয়ারার বেচাকেনা শুরু হয়ে দুপুরের মধ্যেই শুনশান নিরবতা নেমে আসছে।
তবে দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত তরমুজ, পেয়ারা ও আমড়া ছাড়াও ইলিশ মাছ নিয়ে একটি ‘রপ্তানী প্রক্রিয়াকরন অঞ্চল’ গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদগন। সঠিক বাজার সহ উৎপাদকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত কল্পে সরকারী পদক্ষেপ এ অঞ্চলের কৃষিÑঅর্থনীতি সহ রপ্তানী বাজারকেও সম্প্রসারন করবে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। দেশে আহরিত ইলিশের ৬৬Ñ৭০ ভাগই পাওয়া যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীসহ উপকুলীয় এলাকায়। সারা দেশে উৎপাদিত ৪৫ লাখ টন তরমুজের ৩০ লাখ টনই উৎপাদন হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। আমড়া ও পেয়ারা’র সিংহভাগেরই উৎপাদন এ অঞ্চলে। কিন্তু সঠিক বাজারের অভাবে এ অঞ্চলের আর্থÑসামাজিক ব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন আসছে না। এক সময়ে ইপিজেড-এর চেয়ারম্যান সহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগন দক্ষিনাঞ্চল ঘুরে ইতিবাচক মতামত দিলেও পরবর্তিতে সব স্থিমিত হয়ে গেছে। এমনকি দক্ষিণাঞ্চলে দুটি ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত এখনো কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ।