3:38 pm , June 12, 2022
২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ কর্মের পাশাপাশি মানবসেবা মানুষের অন্যতম ধর্ম এমন সরল উপলব্ধি অমৃত লাল দে’র। এ কারণেই তিনি মানবসেবায় নিয়োজিত করেছেন নিজেকে। উদারহস্তে দান করেছেন। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর অংশ্রগ্রহণমূলক সহযোগিতা ওইসব অঙ্গনকে করেছে সজীব ও প্রাণবন্ত। তিনি আর কেউই নয়Ñ দানবীর অমৃত লাল দে। তিনি ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১৩ই আষাঢ়/ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুন শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার চ-ীপুরের পাঁচগাঁও গ্রামে অমৃত লাল দে-এর জন্ম। পিতার নাম রাসমোহন দে। মা সারদা সুন্দরী দে। তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন শ্রীমতি যোগমায়া দে। ১৪০০ বঙ্গাব্দের ৩০শে জৈষ্ঠ্য/ ১৯৯৩ সালের ১৪ই জুন ঊনসত্তর বছরে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৪ই জুন অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অবস্থিত সমাধি মন্দিরে পারিবারিকভাবে পুষ্পার্ঘ্য অর্পন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সুশীল সমাজের কাছে অমৃত লাল দে ছিলেন ‘অমৃতদা’। শ্রমজীবী মানুষের কাছে প্রিয় এই মানুষটি ছিলেন ‘বড়কাকু’। অমৃত লাল বিশ্বাস করতেনÑ সমাজকে সচল রাখতে হলে শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি এবং খেলাধুলা অঙ্গনকে সচল রাখতে হবে। এই অঙ্গনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা না করলে সমাজে অবক্ষয় দেখা দেবে। শান্তি বিঘিœত হবে। মানুষের প্রতিভার যেমন বিকাশ ঘটবে না তেমনি সুকুমার মনোবৃত্তিগুলোও বিনষ্ট হবে। তাই আধুনিক মনস্ক ব্যক্তিত্ব অমৃত লাল দে ইতিবাচক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন সবার আগে। সমাজ সচেতন মানুষ মাত্রেই স্বীকার করেনÑ আধুনিক বরিশালের রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত যেখানে শেষ করে গেছেন, অমৃত লাল দে সেখান থেকেই শুরু করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন বলেই তিনি হতে পেরেছেন সমাজসেবী, দানবীর, সমাজ সংস্কারক। বরিশালের শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক আন্দোলনের পীঠস্থান অশ্বিনী কুমার হলের তিনি সংস্কারক। বরিশাল কেন্দ্রীয় শহিদমিনার নির্মাণে তাঁর বিশাল অঙ্কের দান, বরিশাল ক্লাবের অমৃত লাল দে মিলনায়তন তাঁর অর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁর অর্থানুকুল্যে রামকৃষ্ণ মিশনের বর্তমান নবনির্মিত মন্দির এবং মিশনের দাতব্য চিকিৎসালয়, সারদাভবন ও সারদা ঘাটলা গড়ে উঠেছে। নগরীর স-রোডে মমতাজ মুজিদুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। জগদীশ সারস্বত উচ্চ বিদ্যালয়ের অমৃত ভবন ও যোগমায়া ভবন নির্মিত হয়েছে তাঁর অর্থানুকূল্যে। বরিশাল ধর্মরক্ষিণী সভার বিভিন্ন সময়ে যে সংস্কার করা হয় তার খরচ সংকুলন করা হয় তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শতবর্ষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিদ্যালয়ের বিশাল হল রুমটি তিনি সংস্কার করেন বিপুল অর্থ ব্যয় করে। এ ছাড়াও ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে অমৃত লাল দে ট্রাস্ট ফান্ড নামে স্থায়ী বৃত্তির ব্যবস্থা করে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিকাশে সহায়তা করার ব্যবস্থা করেছেন। শ্রী চৈতন্য গোবিন্দ মোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বাজার রোডের খাজা মাঈনুদ্দিন আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপনে আর্থিক সহায়তা প্রদান, হাটখোলা হরি মন্দির, নড়িয়ার শ্রীরাম ঠাকুরের আশ্রম নির্মাণে তিনি আর্থিক সহায়তা করেছেন। তাঁর অন্যতম কীর্তি শহরের অন্যতম কেন্দ্রস্থল অমৃত লাল দে সড়কে অবস্থিত অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর স্বপ্ন আজ সার্থক হয়েছে। বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠিসহ এই অঞ্চলের সর্বত্র আছে তাঁর দান। এ অঞ্চলের শতাধিক মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ তাঁর অর্থানুকুল্যে সংস্কার হয়েছে, নির্মিত হয়েছে এবং পরিচালিত হত। শুধু দান নয়, সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতিও ছিল তাঁর অসম্ভব আগ্রহ। এ ক্ষেত্রে অমৃত লাল দে যেমন সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করতেন তেমনি তাঁর উত্তরসূরিরা আজও তা অব্যাহত রয়েছে অমৃত কনজুমার প্রোডাক্টস্-এর অর্থানুকুল্যে। অমৃত লাল দে বরিশাল ধর্মরক্ষিণী সভাগৃহ এবং বরিশাল মহাশ্মশান রক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজে যেমন প্রচুর অর্থ দিয়েছেন তেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছেন। তাঁর যুক্তি ছিল ধর্মরক্ষিণী সভায় হিন্দু সমাজের সকলের অধিকার আছে। প্রত্যেকেরই সামর্থ্য অনুসারে আর্থিক সাহায্য করে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা উচিত। সমাজসেবার মাধ্যমে সরাসরি সর্বস্তরের মানুষের সাথে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তিনি ভুলে যেতেন শারীরিক দুর্বলতার কথা। তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ধর্মরক্ষিণী সভাগৃহের কার্যকরী পরিষদে ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৩ এর জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অর্থাৎ আমৃত্যু সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে সুনামের সাথে চিরবিদায় নিয়েছেন। অমৃত লাল দে-এর সমাজসেবায় আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাই প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী দুর্গত মানুষের পাশে তাঁর সরব উপস্থিতির মধ্যে। ১৯৭০ সালে ভোলা-পটুয়াখালীর উপকূল এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় শতাব্দীর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। তাতে প্রায় তের লাখ মানুষের সলিল সমাধি ঘটে। সমগ্র উপকূল এলাকা বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। মানবপ্রেমিক অমৃত লাল দে-এর হৃদয় কেঁপে উঠল এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে। তিনি সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ছুটে গেলেন দুর্গত মানুষের মাঝে। ১৯৮৮ সালে সর্বনাশা বন্যায় উজিরপুর এলাকার পঞ্চাশ হাজার জলবন্দি মানুষকে খাবার যোগান দিয়েছেন লঙ্গরখানা খুলে। একমাস ধরে এ লঙ্গরখানা চালু ছিল। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপর দিয়ে যাওয়া প্রচ- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন তিনি। ১৯৯৮ সালে স্মরণাতীতকালের দীর্ঘ সময়ের বন্যায় দেশের পাঁচ ভাগের চার ভাগ নিমজ্জিত হয়েছিল দীর্ঘ তিন মাস। তখন অমৃত লাল দে-এর গড়া প্রতিষ্ঠান কারিকর বিড়ির পক্ষ থেকে তাঁর উত্তরসুরিরা বিভিন্ন এলাকার দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার ব্যবস্থা করেন। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশের সামগ্রীক পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। সেসময়ও অমৃত পরিবার তার সাধ্যানুযায়ী তাৎক্ষণিক ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিল দুর্গত মানুষের পাশে। দানবীর অমৃত লাল দে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন তৈরি, শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান ছাড়াও তিনি তাঁর কর্ম জীবনের শেষ দিকে স্থাপন করেন দক্ষিণাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়। শিক্ষার প্রতি অসীম ভালবাসা-দায়িত্ববোধ অমৃত লাল দে’কে তাড়িয়ে বেড়াতো। এরই ধারাবাহিকতায় অমৃত পরিবার নগরীতে শিশুশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান করেন অমৃত লাল দে কিন্ডারগার্টেন। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় অমৃত লাল দে আয়ুর্বেদ ও ইউনানী মহাবিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশক হিসেবেও অমৃত লাল দে বরিশালবাসীর কাছে সমাদৃত। শিক্ষানুরাগী অমৃত লাল দে-এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়েছে বরিশালের লোকসাহিত্য, অশ্বিনী কুমার রচনা সমগ্র, আচার্য জগদীশ কথামৃত, বরিশাল ধর্মরক্ষিণী সভা ও কামিনী সুন্দরী চতুষ্পাঠী : ইতিহাস ও বিকাশ, বাখরগঞ্জ জেলার ইতিহাস প্রভৃতি আকর গ্রন্থ। অমৃত লাল দে-এর ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে প্রকাশ করেছেনÑ বরিশালের মন্দির মসজিদ, আচার্য জগদীশ কথামৃত (দ্বিতীয় সংস্করণ), শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে কালের ধ্বনি, শ্রীরামকৃষ্ণ মরমহংস দেব স্মরণে চরিতামৃত, শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ব্যাখ্যা সম্বলিত গীতামৃত (২খ-), গীতা প্রবচন, মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস হোসেনের কবিতা গ্রন্থ। আজও এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর ভাই রাখালচন্দ্র দে, বিজয় কৃষ্ণ দে। দক্ষিণাঞ্চলের যে কোন ইতিবাচক কর্মকা-ে অমৃত পরিবারের অবদান মানুষ স্মরণ করছে শ্রদ্ধার সাথে। ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মহৎপ্রাণ অমৃত লাল দে-এর প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।