3:04 pm , May 8, 2022
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ এবারো দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশে গম উৎপাদনে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। ভাল দাম ও রোগ বালাই সহনশীল বিপুল সম্ভাবনাময় এ দানাদার খাদ্য ফসল আবাদে কৃষকদের কাছে কারিগড়ি জ্ঞান হস্তান্তর সহ আগ্রহ সৃষ্টির উদ্যোগ নেই। তবে কৃষি মন্ত্রনালয় ও কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, দেশের দক্ষিনাঞ্চলে গমের আবাদ সম্প্রসারনের যে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে উৎপাদন ২০ লাখ টনে উন্নীত করার চিন্তা ভাবনা চলছে। রোগ প্রতিরোধক এবং তাপ সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল বীজ ও আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌছানোসহ কৃষকের মাঝে যথাযথ আগ্রহ সৃষ্টি করাই এ ফসলের সম্প্রসারনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। বছর চারেক আগে ‘ছত্রাকবাহী ব্লাস্ট’ রোগের সংক্রমনে দক্ষিণÑপশ্চিমাঞ্চলের ৫টি জেলায় বিপুল পরিমান উঠতি গম ফসল বিনষ্টের পরেই সরকারী তরফ থেকে আক্রান্ত জেলাগুলোতে পরবর্তি ৩ বছর আবাদ নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে কৃষকদের মাঝেও আগ্রহে যথেষ্ট ভাটা পড়ে। তবে আশার কথা, বিগত দুটি মৌসুমের মত সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশের কোথাও ছত্রাকবাহী এ রোগের সংক্রমন ঘটেনি। কিন্তু এর পরেও গমের আবাদী জমির পরিমান সাড়ে ৩ লাখ হেক্টরও অতিক্রম করছে না। উৎপাদনও এখন ১২ লাখ টনের নিচে। অথচ এ ফসল নিয়ে যথাযথ নজরদারী করলে আগামী পাঁচ বছরে গমের আবাদী জমির পরিমান ৫ লাখ হেক্টরে উন্নীত করে ২০ লাখ টন গম উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, গত বছর ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দেশে গমের আবাদ হয়েছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরের কাছাকাছি। উৎপাদন ছিল ১২.৩৪ লাখ টন। তার আগের বছর ৩ লাখ ৪২ হাজার ৩শ হেক্টরে আবাদের মাধ্যমে উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩০ টনের মত।
কিন্তু সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে দেশে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল গত বছরের চেয়ে আরো সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর কম, ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫শ হেক্টরে। উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল ১২ লাখ ২৬ হাজার ৪শ টনের মত। কিন্তু সেখানে আবাদ হয়েছে কিছুটা বেশী ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ হেক্টরে। যা গত বছরের প্রায় সমান। কিন্তু অতি সম্প্রতি গম কর্তনের পরে সারা দেশে সর্বমোট উৎপাদন পাওয়া গেছে ১১ লাখ ৬৭ হাজার ২৯৬ টন। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৬৬ হাজার টন কম। ডিএই’র মতে, এবার দেশে গমের গড় উৎপাদন পাওয়া গেছে প্রতি হেক্টরে ৩.৬৫ টন। আবহাওয়া অনুকুল থাকার পাশাপাশি উফশী জাতের মানসম্মত বীজ ও সঠিক পরিচর্যা হলে খুব সহজেই দেশে গমের উৎপাদন হেক্টরে ৪ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলেও মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় ৫৫ হাজার ৫৫০ হেক্টরে গম আবাদের লক্ষ্য থাকলেও সর্বশেষ হিসেবে মোট আবাদ হয়েছে ৪৯ হাজার ৩৮৫ হেক্টরে। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় ৭ হাজার ৪৭০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চুড়ান্ত আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ২৫০ হেক্টরে। যা গত বছরের প্রায় দ্বিগুন। আর বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫টি জেলায় ৪৮ হাজার ৮০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত আবাদ হয়েছিল ৪১ হাজার ৭৪৭ হেক্টরে। যা গত বছরের চেয়ে ৮ হাজার হেক্টর কম। ফলে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় এবার প্রায় ২৩ হাজার টন এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৭৫ টন গম উৎপাদন হয়েছে বলে ডিএই সূত্র জানিয়েছে। এবার বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় গড় উৎপাদন হেক্টরে ২.৯৮ টন হলেও ফরিদপুরের ৫ জেলায় তা ৩.২০ টনে উন্নীত হয়েছে। স্বল্প সেচ এবং সহজ বালাই ব্যবস্থাপনা সহ উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক ভাবে কম ও ভাল দাম পাওয়ায় নিকট অতীতে দেশে গমের আবাদ দ্রুত সম্প্রসারন ঘটলেও ২০১৭ সালে ৫টি জেলায় ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ সংক্রমনে বিপুল আবাদ বিনষ্ট হয়। এমনকি কয়েকটি এলাকায় ফসল আগুনে পুড়িয়ে সংক্রমন প্রতিরোধ করতে হয়েছে। যেসব এলাকায় ব্লাষ্টÑএর সংক্রমন দেখা দেয়, পরবর্তি ৩ বছর সে জেলায় গমের আবাদ নিরুৎসাহিত করে সরকার। ফলে অত্যন্ত সম্ভবনাময় এ ফসল আবাদ সম্প্রসারনের পরিবর্তে ক্রমশ পেছাতে শুরু করে। তবে বিগত দুটি মৌসুমের মত সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুওমেও ব্লাষ্টের সংক্রমন নিয়ন্ত্রনে থাকায় পরিস্থিতি অনুকুলে হলেও অত্যন্ত সম্ভানাময় এ ফসলের আবাদ সম্প্রসারনে তেমন কোন সমন্বিত উদ্যোগ নেই। দেশে গম আবাদের ইতিহাস খুব বেশী দিনের না হলেও খাদ্য ফসল হিসেবে তা ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় শীর্ষস্থান দখল করেছে। সারা বিশ্বে গম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে। ১৯৮৫ সালে দেশে প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের গম আবাদের মাধ্যমে প্রায় ১২ লাখ টন এ দানাদার ফসল উৎপাদন হয়েছিল। কিন্ত এর পর থেকে গমের আবাদ সম্প্রসারনের পরিবর্তে তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশের অনেক জমিতেই গমের পরিবর্তে এখন ভুট্টা ছাড়াও এবার পেয়াঁজের আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। ‘কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ ও ‘গম গবেষনা ইনস্টিটিউট’এর বিজ্ঞানীগন ইতোমধ্যে উচ্চ ফলনশীল ও পরিবেশ উপযোগী একাধিক গম-এর জাত উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি দেশের মত কম শীত প্রধান অঞ্চলের জন্য ‘শতাব্দী’ নামের গম বীজও উদ্ভাবন করেছেন বারি’র বিজ্ঞানীগন। বারি উদ্ভাবিত গম বীজের মধ্যে ‘কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী, শতাব্দী ছাড়াও সৌরভ-বারি-১৯ ও গৌরব-বারি-২০’ নামের উচ্চ ফলনশীল গম বীজও রয়েছে। এসব বীজ থেকে হেক্টর প্রতি সাড়ে ৩টন থেকে সাড়ে ৪ টন পর্যন্ত গম উৎপাদন সম্ভব বলে বারি’র দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। এছাড়া গম গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীগনও আরো একাধীক উচ্চ ফলনশীল গম বীজ উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাতের গম বীজও উদ্ভাবন করেছেন আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগন।