3:27 pm , February 28, 2022

বরিশালের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মকা- ও সিদ্ধান্ত এই মিলনায়তনকে ঘিরে
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বন্ধ এবং অযতœ অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে পড়ে আছে নগরীর ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী অশ্বিনী কুমার হল। সংস্কার করাও এখন ঝুকিপূর্ণ দাবী সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের। তারপরও চলছে সংস্কার বারবার। অনেকের মতে, হলটির মূল ডিজাইন অক্ষুন্ন রেখেই পিলার ও পাটাতন লোহা দিয়ে গড়া সম্ভব। তা না করে ভবন ভেঙে নতুন ভবন করতে চাইলে বাধাতো আসবেই। করোনাকালীন সংকটে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকা- সীমিত হয়ে পড়ায় থেমে গেছে এই হলটির প্রাণচাঞ্চল্য। দূর থেকে আগের মতো চাকচিক্য বা উৎসবমুখরতা চোখে পড়ে না এখানে। কাছে এসে দেখা গেল সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সংস্কার কাজ চলছে মিলনায়তনের ভিতরে।
বরিশাল শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতির ও রাজনৈতিক সমাবেশের প্রাণকেন্দ্র এই অশ্বিনী কুমার মিলনায়তন। এখনও বিভিন্ন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সভা সেমিনার, মানববন্ধন কর্মসূচি এই হলকে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে।
নিয়মিত এখানে রাজনৈতিক সমাবেশ করে অভ্যস্ত বরিশালের আলোচিত মেয়র প্রার্থী বাসদ নেত্রী ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, বরিশালের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মকা- ও সিদ্ধান্ত এই মিলনায়তনকে ঘিরে। তাই এখানে কর্মসূচি পালন করতে ভালো লাগে।
বাসদ নেত্রী বলেন, ১৯৩০ সালে অশ্বিনী কুমার হল নির্মাণ করা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে ইতিহাসে এটাই উল্লেখ আছে। এই টাউন হল নির্মিত হওয়ার পূর্বে বরিশালের সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে। এটা বড়রা ভালো বলতে পারবেন। বড়রা নয়, আমরা সিরাজ উদ্দীন আহমেদ এর বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থ ও উইকিপিডিয়া ঘেঁটেই পেয়ে গেলাম অশ্বিনী কুমার হল নির্মাণের ঘটনাবহুল রহস্য। জানাগেল, কেন অশ্বিনী কুমার নাম হলো এখানে।
এই টাউন হলের ট্রাস্ট দলিলে এর চৌহদ্দির যে বর্ণনা পাওয়া যায় সে বর্ণনামতে রাজা বাহাদুর হাবেলি ছিল এর পূর্ব দিকে বর্তমান কাঠপট্টি রোডের দক্ষিণে এবং চক বাজার রোডের পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে বাজা বাহাদুরের হাবেলিতে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। এই ঘটনা থেকে বরিশালবাসীর নিকট অনুভূত হয় বরিশালের সভা-সমাবেশের জন্য একটি টাউন হল নির্মাণ প্রয়োজন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে অশ্বিনী কুমারকে সভাপতি ও শরৎ চন্দ্র গুহকে সম্পাদক করে হল নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটির উদ্যোগে ১৯২০ সালে টাউন হলের জন্য জমি ক্রয় করা হয়। টাউন হলের ট্রাস্টি দলিলের তথ্যানুযায়ী বাংলা ১৩২৭ সালের ২৮ আশ্বিন মোতাবেক ইংরেজি ১৯২০ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে এই জমি খরিদ করা হয়। ট্রাস্টি দলিলে লিখিত আছে- ‘আমরা অনেক পরিশ্রম করিয়া এবং নিজ হইতে যথাসাধ্য চাঁদা দিয়া এবং সর্বসাধারণ হইতে চাঁদা সংগ্রহ করিয়া বরিশালের সর্বসাধারণের উপকারার্থে সভাসমিতির অধিবেশন, নির্দোষ আমোদ ও প্রমোদ অনুষ্ঠান ও জনহিতকর কার্যের জন্য একটি টাউন হল স্থাপনার উদ্দেশ্যে নি¤েœর (ক) তফসিলে লিখিত ভূমি মং ৪০০০/- (চারি হাজার) টাকা মূল্যে শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মহাশয়ের নিকট হইতে ১৩২৭ সালের ২৮ আশ্বিন তারিখে সম্পাদিত রেজিস্ট্রিকৃত কবলামূলে শ্রীযুক্ত হরনাথ ঘোষ, অশ্বিনী কুমার দত্ত, তারিণী কুমার গুপ্ত এবং একে ফজলুল হক (শেরেবাংলা) সাহেবের নামে খরিদ করিয়া পাকা টাউন হল নির্মাণ করিতেছি’।
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ লিখেছেন যে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর উকিল বরদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় রাজা বাহাদুরের মালিকদের নিকট হতে উক্ত ভূমি ক্রয় করেন। কিন্তু ট্রাস্ট দলিলের ভাষ্য অনুযায়ী এই তথ্য সঠিক নয়। বরং সঠিক তথ্য হলো জমিটি কেনা হয়েছিল শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মহাশয়ের নিকট থেকে শ্রীযুক্ত হরনাথ ঘোষ, অশি^নীকুমার দত্ত, তারিণীকুমার গুপ্ত এবং এ কে ফজলুল হকের নামে।
ট্রাস্ট দলিলে উল্লিখিত তারিখ মোতাবেক এই ট্রাস্ট দলিল সম্পাদিত হয়েছে ১৩৩২ বাংলা সনের ২৭শে বৈশাখ মোতাবেক ১৯২৫ সালের ১০ মে ।
ট্রাস্ট দলিলের তথ্য অনুযায়ী অশ্বিনী কুমার টাউন হলের ট্রাস্টি ছিলেন ৫৩ জন। তন্মধ্যে কয়েকজন হলেন সরল কুমার দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ সেন, দিলীপ কুমার রায়, যোগেন্দ্রনাথ সেন, মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, দক্ষিণারঞ্জন রায় চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী, জ্ঞানেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী, হাজি চৌধুরী মুহাম্মদ ইসমাইল খান, নওয়াবজাদা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, মৌলভী আবুল কাসেম ফজলাল হক, ফকরউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। আমরা এখন জানি অশ্বিনী কুমার টাউন হলে যে কোনো ধরনের খুশি অনুষ্ঠান করা যায়। কিন্তু ঐ সময় তা যেতো না। ঐ সময় এর ট্রাস্ট দলিলে লিখিত ছিলো- ‘নির্দোষ আমোদ ও প্রমোদ অনুষ্ঠান’ এ শব্দটিকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানের এক তথ্য মোতাবেক দেখা যায়, এখানে সিনেমা দেখানো আরম্ভ হলে তার প্রতিবাদ করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা শরৎ কুমার ঘোষ অনশনব্রত পর্যন্ত পালন করেছিলেন।
পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে ষাটের দশকে নির্লজ্জভাবে এই টাউন হলটি আইয়ুব খানের নামে নামকরণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সালে হলটির নাম আইউব খান টাউন হল এবং গেট দুটি যথাক্রমে গেটে মিল্লাত ও কায়েদে আজম নাম লিখে তৎকালীন বিহারী জেলা প্রশাসক সাইনর্বোড টানিয়ে দিলে তা স্থানীয় লোকজন আন্দোলন করে ভেঙ্গে দেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গণগঙ্গীতশিল্পী আক্কাস হোসেন। জনতার রোষের সামনে তা করতে না পেরে সরকারিভাবে এর নাম বলা হচ্ছিলো একে হল, যা দিয়ে ভিতরে ভিতরে বোঝানো হতো আইয়ুব খান হল, কিন্তু ঠেকায় পড়লে বলা হতো একে মানে আবুল কাসেম বা অশ্বিনী কুমার বলে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা ছিলো। শেরেবাংলা এর সাথে কি করে যুক্ত হলেন, অশ্বিনী কুমার টাউন হল হল নামকরণ নিয়ে সমস্যা হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে ২০১২ সালে সাহিত্য বাজার ডটকমকে সরাসরি সাক্ষাতে প্রয়াত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধেয় নিখিল সেন বলেছিলেন, এ নিয়েও বেশকিছু বিতর্ক উঠেছিলো। শেরেবাংলা তখন কলকাতার মেয়র ছিলেন। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের খুব স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। তখন স্বয়ং শেরেবাংলা ফজলুল হক অশ্বিনী কুমার টাউন হল নামকরণে গুরুত্ব আরোপ করেন।
সব মিলিয়ে অশ্বিনী কুমার টাউন হল বরিশালবাসীর এক জাগ্রত চেতনার প্রতীক। ব্রজমোহন বা বিএম কলেজের রাজনীতিরও চেতনার কেন্দ্র ছিলো এই টাউন হলটি। যা গত প্রায় ১০০ বছর ধরে একইরকম অবস্থায় রয়েছে। বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হলেও ভবনের মুল ভিত্তি ঠিক রাখা হয়েছে বলে জানান বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার সভাপতি সৈয়দ দুলাল।
আর সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, মেয়র মহোদয় টাউনহলটির সংস্কার করে আধুনিক করার দায়িত্ব নিয়েছেন। ভিতরে তিনটি ওয়াশরুমসহ যতটা আধুনিক করা যায় তা তিনি করবেন বলেছেন। বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে। তবে এটি এখন অনেক ঝুকিপূর্ণ। সংস্কার করাও কঠিন। তাই ধীরগতিতে চলছে কাজ।
সংস্কার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সিটি করপোরেশনের সিইও সৈয়দ ফারুক আহম্মদ জানালেন, সংস্কার কাজ প্রায় শেষের দিকে। হয়তো মার্চের অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে।