3:42 pm , January 7, 2022
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রশাসনিকভাবে অবহেলা ও অনিয়মের আরেক নাম বরিশাল শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতাল। দক্ষিনাঞ্চলবাসীর একমাত্র বৃহৎ এ স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক পরিস্থিতি দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে এ হাসপাতালের প্রশাসনিক দুর্বলতা। বৃহস্পতিবার রাতে রেডিওথেরাপির প্রয়োজনে ফোন করতেই হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানালেন, কোনো রেডিওথেরাপি হয় না এখানে। বর্তমানে আগত রোগীদের সাধারণ ভাবে ওষুধের মাধ্যমে থেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হয়। কোনো রেডিওথেরাপি হয়না। এদিকে খুলনা থেকে পাঠানো রোগীর স্বজন হাসান বলছেন, খুলনার চিকিৎসকরা এখানে পাঠিয়েছেন। ফলে বিভ্রান্তি দূর করতে হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলামকে ফোন করলে তিনি জানান, নিশ্চিন্তে চলে আসুন। আগে না হলেও এখন রেডিওথেরাপি সম্ভব হবে। শুক্রবার বেলা এগারোটায় রোগী নিয়ে এসে দেখা গেল ভয়াবহ চিত্র। অনুসন্ধানসহ সব চিকিৎসক ও সহকারী কক্ষ ফাঁকা। তালা ঝুলছে প্রতিটি বিভাগে। পুরাতনভবনের দোতালায় রেডিওথেরাপি বিভাগেও মস্ত তালা। বিভাগীয় প্রধান ডা. মহসিনের ফোন নম্বর দিতে পারেনি কর্তব্যরত দুইজন নার্স। তারা জানালেন, শুক্রবার বন্ধতো। তাই কাউকে পাবেন না। আগামীকাল আসুন।
হাসপাতালের প্রতিটি সিড়ি ও আশে-পাশের পরিবেশ এতোটাই নোংরা দ্বিধা হচ্ছে এটাকে হাসপাতাল বলতেও। দিনের বেলাতেও হাসপাতালের সিড়ি অন্ধকারাচ্ছন্ন। অথচ বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার শেষ ভরসাস্থল এই হাসপাতাল।
১৯৬৮ সালে স্থাপিত এই হাসপাতালের দশ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউর সাথে ২০২০ সালে করোনা বিভাগ এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৮ টি আইসিউ শয্যা ও ১৫০ টি নতুন বেড নিয়ে। সবমিলিয়ে আইসিইউ এখন ২৮ টি এবং শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ১৫০টি থাকার কথা। প্রতিদিন গড়ে চল্লিশজনের করোনা পরীক্ষা এখনো চলমান আছে। তবে তা নতুন ভবনে অদক্ষ অফিস সহকারীদের নিয়ন্ত্রণে দেখা গেল। করোনা ইউনিটের নতুন ভবনের নীচতলার একাংশ ব্যবহার হচ্ছে। দেখা গেল বাকীটা তালাবদ্ধ। এখানে রয়েছে একটি একাডেমিক ভবন, ৩টি ছাত্রাবাস, ২টি ছাত্রী নিবাস, ২টি ইন্টার্নী ডক্টরস হোস্টেল, ১টি নার্সিং কলেজ, ১টি নার্সিং ছাত্রীনিবাস, ১টি নার্সিং ছাত্রাবাস, ১টি মসজিদ, ১টি জিমনেসিয়াম ও সুবিশাল খেলার মাঠ। যে মাঠে রোগীদের কাপড় শোকানোর প্রতিযোগিতা চলে এখন।
ক্যাম্পাসের মধ্যে ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড এলাইড সাইন্সেস, আর এইচ স্টেপ, মর্গ, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ডক্টর্স কর্ণার রয়েছে। যা কখনোই কোনো উপকারে আসে না কারো।
কলেজের সামনে একটি শহিদ মিনার অপরিচ্ছন্ন আর অবজ্ঞার স্মৃতি বহন করে। আছে একটি মুক্তমঞ্চ ও গোল্ডেন জুবলি উদ্?যাপনের স্মারক স্তম্ভ। ২০১৮ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়েছে। তারপর বিশেষ দিন ছাড়া অযতœ অবহেলার সাক্ষী বহন করছে এখন।
হাসপাতাল ঘুরে ফেরার পথে অনুসন্ধান কক্ষে পাওয়া গেল একজন সুপারভাইজারকে। নিজের নাম খলিল জানানো ওই সুপারভাইজার জানালেন, প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসছেন। এ বিষয়ে বিভাগীয় প্রধান ভালো বলতে পারবেন। আপনি আগামীকাল আসুন।
কথা বলে যতটা বোঝা গেল, বিভিন্ন ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সাথেই থাকেন এখানে আসা ক্যান্সার রোগীরা। আলাদা কোনো কক্ষ নেই। এখানে শুধু ক্যামোথেরাপি ছাড়া ক্যান্সার রোগের অন্য কোনো চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা দীর্ঘদিন। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগী ও স্বজনদের। কেননা ২০১৫ সালের পর থেকে ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপি প্রদানের ১০ কোটি টাকা মূল্যের মেশিনটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। নেই আধুনিক কোনো উপকরণও।
আধুনিক যন্ত্রপাতির মতোই রয়েছে জনবল সংকট। জনগুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগটি চলছে একজন সহকারী অধ্যাপক ও একজন রেডিওথেরাপিস্ট দিয়ে। বাকি অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিকেল অফিসার, টেকনোলজিস্ট, কম্পিউটার অপারেটর, ফিজিওথেরাপিস্ট সব পদই শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আর তাই যথাযথ চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরতদের।
বর্তমানে এ হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগটি রয়েছে নামমাত্র। চিকিৎসাসেবাও চলছে তেমনি দায়সারা। অনেকটা শুভাঙ্করের ফাঁকি এই ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট।
রেডিওথেরাপি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মেশিন রেডিওলজি নেই, রেডিও টেলি থেরাপির মেশিন নষ্ট, ব্রকি থেরাপির অবস্থাও অচল। জানা গেল ৪ বছর আগে শেবাচিমে ক্যান্সার রোগীদের জন্য কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছিল এই ব্রাকি থেরাপি মেশিনও। যা এখন পযর্ন্ত একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি শেবাচিমে।
ক্যান্সার চিকিৎসার জরুরী রেডিওথেরাপি অচল হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। অথচ খুলনা, যশোর থেকেও চিকিৎসকরা রোগীদের রেডিওথেরাপি দিতে শেবাচিম হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। দূর দূরান্তের রোগীদের অনেকেই রেডিওথেরাপি দিতে শেবাচিমে ছুটে এসে হতাশায় পড়ছেন বলে জানান স্বয়ং রেডিওথেরাপিস্ট। শেবাচিম হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের ‘দায়িত্বে থাকা সহকারী অধ্যাপক ডা. আনম মইনুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে আরো বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বরিশাল সব সময় অবহেলিত। এখানকার প্রধান সমস্যা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকট। ক্যান্সার রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার স্বার্থে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সরঞ্জামাদিসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বহুবার আবেদন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আবেদন করতে করতে ফাইল ভারী হয়ে গেছে। আমরা এখন ক্লান্ত’।