3:15 pm , October 4, 2021
বর্র্ষার শেষে দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙন তীব্র হচ্ছে
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নদ-নদীবহুল দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙন পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। চলমান নদী ভাঙন রোধ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নও বিলম্বিত হচ্ছে নানামুখী জটিলতা সহ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কালক্ষেপণে। যুগের পর যুগ ধরে নদী ভাঙন দক্ষিণাঞ্চলে একটি মানবিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসলেও তার টেকসই ও দ্রুত প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এখনো অনুপস্থিত। কোনো এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হলে তা প্রতিরোধে প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন শুরু করতেই ৫-৭ বছর চলে যাচ্ছে। আর প্রকল্প অনুমোদনের পরে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতেও লেগে যায় আরো কমপক্ষে ৫ বছর। ততদিনে ঐ এলাকার পুরো মানচিত্রই পাল্টে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত হয়ে ‘সকাল বেলার আমির সন্ধ্যা বেলায় ফকির’-এ পরিনত হচ্ছে।
বর্ষা মৌসুম শেষে উজানের ঢলের পানি বঙ্গোপসাগরে প্রবাহের পথে বর্তমানে নদী ভাঙন যথেষ্ট তীব্র আকার ধারণ করেছে। যা আরো অন্তত দুই মাস অব্যাহত থাকতে পারে বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞগণ। নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপ সাগর। যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। আর উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা, তেতুলিয়া, বলেশ^র, বিষখালী সহ বিভিন্ন নদ-নদী যেমনি বর্ষা মৌসুমে দুকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি বর্ষার শেষে নদী ভাঙনও তীব্র আকার ধারন করে।
তবে গত দুই দশকে সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলেও নদী ভাঙন প্রতিরোধে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা অতীতের যেকোন সময়ে তুলনায় অনেক বেশী হলেও বাস্তবায়ন যথেষ্ঠ ধীর। বর্তমানে ঝালকাঠি বাদে দক্ষিণাঞ্চলের অপর ৫টি জেলায় ৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩টি নদী শাসন ও ভাঙন রোধ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
নগরী সহ সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদী দীর্ঘদিন ধরে চরবাড়িয়ার বিশাল এলাকা গ্রাস করে চলেছে। বহু কাঠখঁড় পুড়িয়ে প্রায় ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫.৬৮ কিলোমিটার নদী তীর রক্ষা, ২১৯ মিটার ‘এন্ড টার্মিনেশন ওয়ার্র্ক’ ছাড়াও ৫.৬ কিলোমিাটার ড্রেজিং করে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাঙন রোধ প্রকল্পটির কাজও চলছে ঢিমেতালে। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও তা আগামী জুনে সম্পন্ন করা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৭০%-এরও কম।
এছাড়া মেঘনার ভাঙন থেকে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া-গোবিন্দপুর এলাকা রক্ষায় ৩৮৪ কোটি টাকার একাটি ভাঙন রোধ প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৬৫%। আড়িয়াল খাঁ নদে ভাঙন থেকে গৌরনদীর হোসনাবাদ বাজার ও লঞ্চ ঘাট সহ সন্নিহিত এলাকায় রক্ষায় প্রায় ৪২ কোটি টাকার অপর ১টি প্রকল্পের কাজ সবেমাত্র শুরুর পর্যায়ে। এর বাইরে বরিশাল-পিরোজপুর-গোপালগঞ্জের সাতলা-বাগদা সেচ প্রকল্পের পোল্ডার সমূহ পূনর্বাসনে ৪৫ কোটি টাকার অপর একটি প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৫৫%।
তবে বরিশাল ছাড়াও পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা জেলার বিভিন্ন এলাকাতেও বর্তমানে ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯টি নদী শাসন প্রকল্প বস্তবায়নাধীন। এসব প্রকল্পের অগ্রগতি ৫০-৭০ ভাগের মধ্যে। বাস্তবায়নাধীন এসব প্রকল্পের মধ্যে ভোলাতে ৬টি এবং পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরে ১টি করে প্রকল্প রয়েছে। ঝালকাঠি জেলায় কোন নদী ভাঙন রোধ প্রকল্প চলমান নেই।
তবে এর বাইরে ২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশালে ৫টি, ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঝালকাঠীতে দুটি, ১ হাজার ২৯২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে পিরোজপুরে ২টি, পাঁচ হাজার ১৫২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালীতে ৯টি প্রকল্প প্রস্তবনা-ডিপিপি পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের ¯্রােত থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষায় প্রায় সাড়ে ৭শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও রয়েছে।
বরগুনাতে ৩ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ৫টি প্রকল্প ছাড়াও মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর গ্রাস থেকে দ্বীপজেলা ভোলার বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা রক্ষায় ৭টি প্রকল্প-সারপত্র পানি উন্নয়য়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রণালয় ছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণ সহ পুনঃগঠন করা হচ্ছে। কিছু প্রকল্প-সারপত্র বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন পর্যায়েও রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙন থেকে লাখ লাখ মানুষের জানমাল রক্ষায় ৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকার চলমান ১৩টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন যেমনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা জরুরী বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞগণ। পাশাপাশি প্রস্তাবিত ৩০টি প্রকল্পের অনুমোদন সহ তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও তড়ান্বিত করার তাগিদ দিয়েছেন মহলটি। নচেৎ দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল জনপদ সহ বিপুল সম্পদ ও সম্ভবনার ফসলী জমি ছাড়াও অনেক মূল্যবান স্থাপনা। এসব বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী মোঃ নুরুল ইসলামের সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, আমরা চেষ্টা করছি দক্ষিণাঞ্চলের নদী ভাঙন রোধে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর দ্রুত অনুমোদন সহ বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে। পাশাপাশি চলমান প্রকল্পগুলোও যাতে নির্ধরিত সময়ে শেষ করা যায়, সে লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক নজরদারী চলছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার নদী ভাঙন রোধে যথেষ্ট আন্তরিক ও আগ্রহী বলেও জানান তিনি।