3:00 pm , March 7, 2021
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের আরেক নাম এখন লেবুখালী ফেরী। পাটুরিয়া-শিমুলিয়া’র পর দেশের ব্যস্ততম ফেরী পয়েন্ট হিসেবে চিন্থিত এই ঘাটে মাত্র ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে নদী পাড়ি দিতে যানবাহন আর মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। চলতি পর্যটন মৌসুমে কুয়াকাটা আর নির্মেয়মান পায়রা বন্দরে যাতায়াত প্রশ্নে তাই নির্ধারিত সময়ের তুলনায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পর্যন্ত বেশী লাগছে যানবাহন আর যাত্রীদের। অভিযোগ উঠেছে ফেরী বিভাগের গাফেলতির কারনেই সৃষ্টি এমন পরিস্থিতির। জরাজীর্ন আর অচলপ্রায় ফেরী দিয়ে এখানে ঘাট চালাচ্ছে তারা। প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্পতা ও অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে ফেরী চালানোর কারনেও হচ্ছে জটিলতা। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারন মানুষকে।
দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত ফেরী পয়েন্ট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া’য় প্রতি ২৪ ঘন্টায় পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা আড়াই হাজারের কিছু বেশী। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার (সাবেক মাওয়া) ফেরী পয়েন্টে এই সংখ্যা প্রায় ১৬ শ’। এই দু’টি ফেরী পয়েন্টের পর তৃতীয় ব্যস্ততম ফেরী পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত লেবুখালীতে প্রতি ২৪ ঘন্টায় পারাপার হয় প্রায় ১৫শ’ যানবাহন। ইউটিলিটি টাইপ ফেরী দিয়ে অভ্যন্তরীন ছোট নদী পারাপার প্রশ্নে এক হাজার ৫শ’ যানবাহন পারাপার করার এই হিসেবটি-ই বলে দেয় যে কত ব্যস্ত এই ফেরী পয়েন্ট। পায়রা নদীর উপর থাকা এই ফেরী পার হয়ে পৌছুতে হয় পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা এবং সমুদ্র বন্দর পায়রা’য়। তাছাড়া পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে লেবুখালী ফেরী। এখানেই এখন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে পর্যটকসহ হাজার হাজার মানুষ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লেবুখালী ফেরী ঘাটে গিয়ে চোখে পরে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। নদীর উত্তর প্রান্তে প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত ঠায় দাড়িয়ে আছে কয়েক শ’ বাস ট্রাক আর ছোট গাড়ি। দক্ষিন প্রান্তের অবস্থা আরো করুন। ঘাট থেকে পাগলার মোড় পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যানবাহনের সারির পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, রোগীবাহি এ্যাম্মুলেন্স। ঝিনাইদহ থেকে ৪০ জনের দল নিয়ে পিকনিক করতে কুয়াকাটা আসা বাস’র চালক ইব্রাহিম মুন্সি জানান, ‘৩ ঘন্টার-ও বেশী সময় ধরে দাড়িয়ে আছি। এখনো ঘাট পর্যন্তই যেতে পারিনি।’ কলাপাড়া থেকে চট্টগ্রামগামী বাস’র যাত্রী আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বাসের ভেতরে আড়াই ঘন্টারও বেশী সময় ধরে বসে আছি। প্রচন্ড গরমে আমার দেড় বছরের বাচ্চা হাসফাস করছে।’ দুর্ভোগের এই চিত্রগুলো দেখার সময় কানে আসে এক অসহায় বাবা’র আর্তনাদ। এম্বুলেন্স’র ভেতরে থাকা ৮ বছরের শিশুকে বাঁচাতে সামনের গাড়িগুলোর ড্রাইভারদের কাছে ছুটছে সে। আটকে পড়া এম্বুলেন্সকে সামনে যাওয়ার একটু জায়গা করে দিতে।
মাত্র ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে নদীটুকু পার হতে কেন এই বিপত্তি খোঁজ নিতে ফেরী ঘাটে গিয়ে চোখে পড়ে দক্ষিন প্রান্ত থাকা দু’টি ফেরী ঘাটের একটিতে চলছে মেরামতের কাজ। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ঘাটে কর্মরত এক ব্যক্তি বলেন, ‘অন্যান্য সময়ের তুলনায় বৃহস্পতি ও শনিবার বিকেলে ঘাটে সবচেয়ে বেশী ভীড় হয়। এই দু’দিন কুয়াকাটামুখি বিপুল সংখ্যক যানবাহনের চাপ থাকে। একটি ফেরীর পন্টুনে সামান্য ক্রুটি দেখা দিয়েছিল। আমরা বলেছিলাম আজ এটির মেরামত না করলেও চলবে। কিন্তু আমাদের কথা না শুনে ব্যস্ত সময়ে কাজটি করায় একটি ঘাট বন্ধ রয়েছে। ফলে সঠিকভাবে যানবাহন পারাপার করা যাচ্ছেনা।’ ফেরীর ইজারাদার পক্ষের সুপারভাইজার ফাইজুল হক বলেন, ‘এখানে থাকা ৬ টি ফেরীর মধ্যে একটি বেশ কিছুদিন ধরেই বিকল। বাকি ফেরীগুলোর ২টি অত্যন্ত পুরোনো। প্রায়ই এগুলো বিকল হয় এবং দিনের পর দিন বসিয়ে রেখে মেরামতের পর চালু হলেও ২/১ দিন চলেই আবার অচল হয়ে পড়ে। বাকি ৩টি ফেরীর মধ্যে ভিআইপি ডিউটির জন্য একটি রেখে ২টি দিয়ে নিয়মিত সার্ভিস চালু রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু এই ফেরী দু’টি খুব একটা বড় না হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী সার্ভিস দেয়া যায়না। ফলে পারাপারের উদ্দেশ্যে ঘাটে আসা যানবাহনগুলোকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাটে বসে থাকতে হয়। এই সমস্যা নিয়ে ফেরী বিভাগকে বহুবার বলেছি। কোন লাভ হয়নি।’ পরিচয় না প্রকাশের শর্তে ফেরী বিভাগের এক কর্মচারী বলেন, ‘এখানে যারা ফেরী চালায় তারা কেউই মাষ্টার নয়। গিজার দিয়ে এসব ফেরী চালায় ফেরী বিভাগ। অদক্ষতার ফলে তারাই ফেরীর ইঞ্জিন নষ্ট করে ফেলে। তাছাড়া সঠিকভাবে ফেরী চালাতে না পারায় এগুলো ঘন ঘন বিকল হয়। মাত্র ক’দিন আগে এখানে দেয়া সম্পুর্ন নতুন একটি ফেরী’র শ্যাফট একারনে ভেঙ্গে গেছে। কবে নাগাদ ঠিক হবে কেউ জানে না।’
ফেরী জটিলতার পাশাপাশি এই ঘাটে যানজটের আরো যেসব কারন রয়েছে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভিআইপি’র চাপ ও চলাচলের অযোগ্য সড়ক। স্থানীয় পুলিশ বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ‘পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় যেতে এই ফেরী পার হতে হয় সকলকে। চলতি পর্যটন মৌসুমে বিভিন্ন দপ্তরের বিপুল সংখ্যক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক ভ্রমনে এই ফেরী পার হয়ে কুয়াকাটা যান। সেই সঙ্গে রয়েছে নদীর উত্তর প্রান্তে থাকা সেনানীবাসের যানবাহন পারাপারে অগ্রাধিকার এবং এমপি মন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতাদের চাপ। এদের পারাপারে বিশেষ ব্যবস্থা করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখতে হয় ফেরী। একারনেও দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।’ লেবুখালী ফেরী পয়েন্টের নিয়ন্ত্রক দুমকি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘এটা ঠিক যে প্রতিদিন গড়ে ৪/৫ জন গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি সামলাতে হয় আমাদের। কিন্তু আমি মনে করি সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ফেরী ঘাটের দু’প্রান্তের সড়কে রোড ডিভাইডার না থাকা এবং ফেরী’র সংকট। ডিভাইডার না থাকায় আগে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে যানবাহনগুলো রাস্তা আটকে ফেলে। যে কারনে জটিলতা বেড়ে যায়।’ পুরো বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সড়ক ও জনপথ পটুয়াখালী’র ফেরী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ওমর ফারুক বলেন, ‘পায়রা নদীর উপর সেতু নির্মানের কাজ চলছে। ফলে দু’পাশের এ্যাপ্রোচ সড়কগুলো বর্তমানে জরাজীর্ন এবং সরু। একারনে যানবাহনের জট দেখা দিচ্ছে।’ ফেরী সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে ওখানে কয়েকটি ফেরীর অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিকল একটি ফেরীর নতুন ইঞ্জিন এসেছে। আশা করি ৩/৪ দিনের মধ্যে সেটা লাগাতে পারবো। অন্য ফেরীগুলোও সচল করার চেষ্টা চলছে। আশাকরি সপ্তাহখানেকের মধ্যে ফেরী সংক্রান্ত জটিলতা আর থাকবেনা।’ ##