আমার দেখা কাইউম ভাই আমার দেখা কাইউম ভাই - ajkerparibartan.com
আমার দেখা কাইউম ভাই

1:29 pm , February 5, 2021

কাজী মকবুল হোসেন

বেশ ক’দিন থেকে মনে তাগিদ অনুভব করছিলাম প্রয়াত আবদুল কাইউম ভাই-এর সাংবাদিকতা ও আইন পেশার সম্পর্কে কিছু লেখার। শ্রদ্ধেয় কাইউম ভাই বয়সে আমার চেয়ে অনেক অগ্রজ ছিলেন। সাংবাদিকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৮১ সালে আমি সাপ্তাহিক খাদেম পত্রিকা থেকে বরিশাল প্রেসক্লাবের সদস্য হই। আবদুল কাইউম তখন প্রেসক্লাবের সভাপতি পদে আসীন। দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার-এর বৃহত্তর বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ছিলেন। একজন সহকর্মী হিসাবে তাকে আমরা ভাই সম্বোধন করতাম। তিনি বরিশালে সাংবাদিকদের কাছে একজন প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। বরিশাল প্রেসক্লাব বর্তমানে যেখানে অবস্থিত সেই জায়গাটা সরকার থেকে ১৯ শতাংশ জমি মাত্র এক লাখ এক টাকায় কিনে নেয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তাই তাকেই একমাত্র বরিশাল প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য পদে সম্মানীত করা হয়েছে। সারা বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস দেখা দেয় ২০২০ সালে। ওই বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কাইউম ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হন। মোবাইলের ফেইসবুকে তার ছোট ভাই প্রফেসর আলমগীর হাই ভাই আবদুল কাইউম ভাই’র রোগমুক্তির জন্য দোয়া চেয়েছিলেন। ফেইসবুকে তার ছবিটাসহ সংবাদটা পেয়ে রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আমরা সবাই প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু আল্লাহ তাকে আমাদের কাছ থেকে চিরতরে নিয়ে গেলেন ২২শে নভেম্বরে। মহান আল্লাহর কাছে তার চিরজীবনের শান্তি কামনা করছি। পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে কাইউম ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে ভর্তি হন। আইনে পড়ার সময় তিনি তৎকালীন ডেইলি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা অফিসে সাব-এডিটর পদে যোগদান করেন। পরে জুনিয়র স্টাফ রিপোর্টার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। আইন বিষয়ে লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর তিনি বরিশাল চলে আসেন। বরিশালে এসে কর্ণকাঠী জি,আর হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক পদে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর ১৯৬০ সালের দিকে আগৈলঝাড়ার ঐতিহাসিক গৈলা হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। বছর দুয়েক ওই দায়িত্ব পালন করে বরিশালে চলে আসেন। আইন পেশা ও সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। ৮০’র দশকে আমি বরিশাল প্রেসক্লাবের দপ্তর সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে কোষাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন প্রায়ই কাইউম ভাইর ফকিরবাড়ী রোডের (বর্তমানে সাংবাদিক ও আইনজীবী মুহম্মদ ইসমাইল হোসেন নেগাবানের ল’ চেম্বার) টিনের ছোট্ট ঘরে চেম্বারে, বার লাইব্রেরীতে (আইনজীবী সমিতি) কিংবা বগুড়া রোডের অক্সফোর্ড মিশন হাইস্কুলের প্রধান গেটের লাগোয়া একতলা বাসভবনে যেতাম কখনো মিটিং বহি, কখনোবা প্রেসক্লাবের চেক-এ স্বাক্ষর আনতে। কাটপট্টি রোড থেকে ১৯৮২ সালের মার্চে সাপ্তাহিক লোকবাণী পত্রিকা বের হয়। আমি স্টাফ রিপোর্টার পদে যোগদান করি। সেই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ক্রীড়াবিদ এস শওকাতুল আলম, নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন শাহজাহান খান, বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন মানবেন্দ্র বটব্যাল। আর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন শ্রদ্ধেয় আবদুল কাইউম। এছাড়া ওই পত্রিকায় আনিসুর রহমান স্বপন, গোপাল সরকার, মীর মনিরুজ্জামান, তিমির দত্ত, ইসমাইল হোসেন নেগাবান মন্টু সাংবাদিকতা করতেন। আর ওই পত্রিকায় হাতেখড়ি হয় মুরাদ আহমেদ ও মুনির হোসেনের। তখন বরিশাল থেকে সাপ্তাহিক হিসাবে খাদেম, বিপ্লবী বাংলাদেশ বের হতো। তখন পত্রিকাগুলো সাহসিকতার সাথে সংবাদ পরিবেশন করতো। সংবাদের গুণগত মান ছিল অতুলনীয়। কাইউম ভাই অফিস ছুটির দিনে সন্ধ্যায় লোকবাণী পত্রিকা অফিসে আসতেন, কয়েক ঘন্টা সময় কাটাতেন। ওখানে বসে অবজারভার এর জন্য খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে পুরো নিউজ লিখতেন ইংরেজিতে। আমি তার হাতের লেখা নিউজ নিয়ে প্রায়ই টেলিগ্রাম অফিসে যেতাম। সেখান থেকে ঢাকা পত্রিকা অফিসে টেলিগ্রামের মাধ্যমে নিউজ পাঠানো হতো। তাই তার সাথে আমার সম্পর্কটা নানা কারণে ছিল নিবিড়। তিনি ছোট ভাই হিসাবে আমাকে সহ অন্যদের যথেষ্ট স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। কাইউম ভাইর বাসার চেম্বারে গেলে মক্কেল না থাকলে সাংবাদিকতা, সমাজ ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতেন। আবার কখনো মজার মজার চুটকি শুনাতেন। তার চুটকি শুনে অ্যাডভোকেট তপন চক্রবর্তী ও আমি না হেসে পারতাম না। কখনো তিনিও হাসতেন। কাইউম ভাই ছিলেন দেওয়ানী আদালতের (সিভিল) আইনজীবী। তাকে দেখেছি বিচারকদের কাছে মক্কেলের পক্ষে তার যুক্তি-তর্ক অতি অল্প কথায় উপস্থাপন করতে। তার উপস্থাপনা ছিল বুলেটের মত। কোন মক্কেল মামলা নিয়ে আসলে মামলার মেরিট নেই মনে হলে তিনি বলতেন মামলা করে লাভ হবে না। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত তিনি জিপি (গভর্মেন্ট প্লিডার) দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর বরিশাল প্রেসক্লাবের ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর একাধারে সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। ৯০’র পরপরই তিনি বরিশাল ত্যাগ করে ঢাকা চলে যান। তিনি হাইকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হন। হাইকোর্টের ডেপুটি এটর্নী জেনারেল এর দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় তার কোন খাঁদ ছিল না। পেশাগত কোনটাতেই নীতি থেকে বিচ্যুত হননি কখনো। নিজের আত্মবিশ্বাসের প্রতি ছিলেন অনড়। তাই সবক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অতি সাধারণ, স্বাভাবিক ও সু-শৃঙ্খল। রুচিবোধ, নিষ্ঠাবান, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি ধীরগতিতে হাঁটতেন। ছিলেন তীক্ষè বুদ্ধির অধিকারী। আমৃত্যু বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কখনো নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দেননি। সমাজে অন্যায়, অনিয়ম, বৈষম্য ও শোষণে তাকে ব্যথিত হতে দেখিছি। তিনি ছিলেন শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের পক্ষে। অন্যায়কারীকে ঘৃণা করতেন। অসৎ ব্যক্তি যেই হোক তাকে তিরস্কার করতেন। কাইউম ভাই ঢাকার সোবাহানবাগ এলাকায় নিজ বাসভবনে থাকতেন। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে ডিগ্রীধারী ডাক্তার আর অন্য ছেলে ও মেয়ে বিদেশে অবস্থান করেন। ৯০ দশকের কয়েক বছর পর আমি তার ঢাকার বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দেখে মনে হয়েছিল অতি আপনজন কেউ এসেছে। আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন সেদিন। বরিশালের সাংবাদিকদের একে একে নাম ধরে কে, কি করে, কেমন আছে। পত্রিকা কেমন চলছে জিজ্ঞেস করেছিলেন। প্রেসক্লাবের হাল-হকিকত ও রাজনীতির অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন। ঘন্টা তিনেক কথায় কাটিয়েছিলেন আমার সাথে। তার সেই আন্তরিকতা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। তিনি বরিশাল আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মাঝে মধ্যে আসতেন। কাইউম ভাইকে একজন সহকর্মী হিসেবে কাছে পাওয়ার আগে তাকে চিনতাম অন্য ভাবে। স্বাধীনতার আগে আমি যখন বি.এম স্কুলে পড়ি, তখন তার শ্যালক রফিক ছিল আমার সহপাঠী। রফিক এর বাসা ছিল বি.এম স্কুলের উত্তর পাশের গলির মুখে। সেই বাসায় আমার যাওয়া-আসা ছিল। তাই কাইউম ভাইকে চেনা-জানা অনেক আগ থেকেই। আজ কাইউম ভাই নেই। আমার কাছে তিনি একজন আদর্শের জীবন্ত কিংবদন্তি। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। মহান রাব্বুল আল আমিন তাকে জান্নাতবাসী করুন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT