আমতলীতে হুমকির মুখে প্রাণ বৈচিত্র্য আমতলীতে হুমকির মুখে প্রাণ বৈচিত্র্য - ajkerparibartan.com
আমতলীতে হুমকির মুখে প্রাণ বৈচিত্র্য

3:28 pm , December 29, 2020

 

আমতলী প্রতিবেদক ॥ আমতলী উপজেলার আমতলী সদর , চাওড়া, হলদিয়া ইউনিয়নের সুপ্রাচীন কয়েকটি গ্রাম ‘লোদা , মহিষডাঙ্গা, হলদিয়া, ছাব্বিস কান্দা, গুরুদল, তুজির গোজা , কাউনিয়া, চন্দ্রা, সমিতির বাধ . কালিগঞ্জের বাধ, তালুকদার বাজার , রামজি , পশ্চিম চিলা, পূর্বচিলাসহ এই তিনটি ইউনিয়নের ৪০ টি গ্রাম । চারদিকে সবুজে ঘেরা এই গ্রামগুলোতে গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ও উঠানভরা শাক-সবজি ছিল। সুখে-শান্তিতেই চলছিল প্রাণ-বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এই গ্রামগুলোর হাজার হাজার পরিবারের জীবন-জীবিকা। কিন্তু এই সুখ-শান্তি যেন কপালে সইলো না তাদের। কারণ, ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও কচুরীপানায় আশঙ্কায় চিন্তিত এখানকার প্রতিটি মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন করা হতো। উঠানে উঠানে ছিল শাক-সবজির সমারোহ। শত শত প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছে সবুজে ঘেরা ছিল চারদিক। কিন্তু গত কয়েক বছর পূর্বে সুবান্ধী নামক স্থানে একটি বাঁধের কারনে বর্ষা কালে জলাবদ্ধতা আর শুকনো মৌসুমে পানির জন্য হাহাকারের কারনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এ গ্রাম গুলোর প্রাণবৈচিত্র্য।
স্থানীয় কৃষক মো. নান্নু মিয়া জানান, আগে জমিতে তিন ফসল হতো। এখন একটা ফসল কোনোমতে হয়। কিন্তু এখনই জলাবদ্ধতা ও কচুরি পানা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে পরের বছর হয়তো অনেক কিছুই থাকবে না, এক এক করে গ্রামগুলো হয়ে পড়বে শূন্য। দেখা দেবে অপুষ্টি। কর্মহীন হয়ে পড়বে মানুষ। এলাকা ছাড়তে হবে অনেককেই। এ ব্যাপারে সাবেক ইউপি সদস্য মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সুবান্ধী বাধের কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামগুলো বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর জলাবদ্ধতায় এলাকায় কোটি কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ষাটের দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড এ বাধটি নির্মান করলেও ১৯৮৬ সনে জনগণের দাবীর মুখে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান সুবন্ধি বাধ কেটে দেন।
২০০৮ সনে পানি উন্নয়ন বোর্ড জনগণের দাবী উপেক্ষা করে পুনরায় বাধ দেন। পরবর্তীতে পানি নিস্কাষনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড সুবান্ধি পয়েন্টে দুব্যন্ডের একটি স্লুইজ নির্মান করলেও ৩০ কিমি লম্বা এবং প্রায় কোয়াটার কিলোমিটার প্রশস্ত খালের পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে দুব্যন্ডের স্লুইজ কোনভাবেই যথার্থ নয়। সুবন্ধি সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসকের গঠন করা তদন্ত কমিটি একাধিকার সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। পাশাপাশি দু ব্যান্ডের স্লুইজ নির্মান করার আগে বিশ্ব ব্যাংকের টেকনিক্যাল এডভাইজরি গ্রুপের সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শন করে যে সুপারিশ দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড তা মানেননি বলে একটি সুত্র নিশ্চিত করেছে। উল্লেখ্য বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় দু ব্যান্ডের এ স্লুইজ নির্মান করা হয়েছে। অন্যদিকে এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যাক্তি ¯ুইজ গেট আটকিয়ে মাছ ধরছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বাধ নির্মানে লবন পানি প্রবেশের অজুহাত তুললেও বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন নদীগুলোর লবনাক্ততা বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ের স্টাডি বলছে, পায়রা বিষখালী এবং বলেশ্বর মোহনায় মার্চের প্রথম থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত লবনাক্ততা থাকলেও তালতলীর পর পায়রা নদীতে লবনাক্ততা সহনীয় মাত্রার এবং বগি বাজারের পর থেকে লবনাক্ততা খুব কম। আন্দারমানিক এবং রামনা বাদ চ্যানেলের লোন্দা পয়েন্ট পর্যন্ত মার্চের প্রথম থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত লবনাক্ততা থাকলেও সুবন্ধি পয়েন্টে লবনাক্ততা নেই কালেভদ্রে দেখা গেলেও তা খুবই সহনীয় মাত্রার সিডরের সময় সুবন্ধি খোলা ছিল। সুবন্ধি ও জলেখার স্লুইজ থেকে আমতলী পর্যন্ত চাওড়া ও হলদিয়া খালের দুপাড়ে ২১টি কার্লভার্ট ও ইনলেটসহ উচু রাস্তা রয়েছে। যে কারনে সিডরে এসব এলাকায় তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শুধু পানি নিস্কাষন নয় এ অঞ্চলের কৃষকের কৃষি পণ্য পরিবহণ বাজারজাতকরণের জন্য সুবন্ধি উম্মুক্ত রাখা জরুরী। মৎস্য,পশু সম্পদ ও দৈনন্দিন কাজ এবং প্রায় ৫শ জেলের জীবন জীবিকা ছাড়াও এ খালটি খোলা থাকলে যেমনি কৃষি উৎপাদন বাড়ে তেমনি কৃষি পণ্য বিশেষ করে ধান ডালসহ কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম মন প্রতি ২০ টাকা বেশী থাকে। তরমুজ এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশী উৎপাদিত কৃষি পণ্য। এ খালটি খোলা থাকলে পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা পেয়ে তরমুজের উৎপাদন বাড়ে তেমনি সহজ পরিবহণ ও বাজারজাতকরণের কারনে কৃষক ন্যায্য মূল্যও পায়। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে,সুবান্ধি বাধের কারণে আমন এবং এ অঞ্চলে আউশের ফলন এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। অন্যদিকে আউশ ও তরমুজ উৎপাদনে সেচ খরচ দ্বিগুন বেড়েছে। এ বাধের কারণে কৃষি উৎপাদন,বাজারজাতকরণ, মৎস্য, পশুপালন,পরিবেশ-জীববৈচিত্র ও জনস্বাস্থ্যে ক্ষতির পরিমান বছরে ২ শ ১৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত ৮ বছরে মোট ক্ষতির পরিমান প্রায় এক হাজার ৭শ ৫২ কোটি টাকা।সরেজমিন পরিদর্শনকালে চাওড়া ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রব , আলী, আবুল হালদার, রফিক ও নসু ,মোজাম্মেলসহ আরও অনেকে জানান পানি প্রবাহ অনিয়মিত থাকায় খালে কচুরিপানার সৃষ্টি হয়ে পানি নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি ফসলের জন্য বিখ্যাত এ অঞ্চলে আর ফসল হয়না। চাওড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান বাদল খান জানান, বর্তমানে খালের যে অবস্থা তাতে কৃষকদের সমস্যার কোন অন্তনেই। একটি বে-সরকারী সংস্থা নির্বাহি পরিচালক বলেন ২ ব্র্যান্ডের স্লুইজে কৃষকের কোন উপকারে আসবেনা সুবান্ধি বাঁধটি চাওড়া,হলদিয়া, কুকুয়া বাসীর জন্য মরন ফাঁদে পরিনত হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ।আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আসাদুজ্জামান বলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিষয়টি অবহিত করা হবে। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার আলম মুঠোফোনে বলেন, চাওড়া-সুবান্দি নদীর পানি নিষ্কাশন ও কচুরীপানা অপসারণে এবং আড়পাঙ্গাশিয়া, ঘটখালী ও আমতলী পৌরশহর রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭২৬ কোটি টাকা ডিপিপি (ডকুমেন্ট অফ প্রজেক্ট প্রফর্মা) জমা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব মহোদ্বয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমতলী উপজেলার সুবান্ধীবাদ সংশ্লিষ্ট মানুষসহ উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে জানান । সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষি উৎপাদন এবং ৮০ হাজার কৃষকের জীবন জীবিকার কখা বিবেচনা করে খালে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরী। পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় সুবান্ধি বাঁধ কেটে দেয়া অথবা বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া । সুবান্ধি খালের পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা খালের দুপাড়ের হাজারো মানুষের প্রাণের দাবী।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT