3:28 pm , November 16, 2020

কাজী মিজানুর রহমান ॥ ঘুম থেকে উঠতেই চারিদিক দিয়ে উচ্চশব্দ আসছে, পাশেই ভবন নির্মানের জন্য মেশিনে ইট ভাঙছে। টাইলস কাটার
প্রচ- শব্দে কান ঝালাপালা। পাইলিং মেশিনের উচ্চ আওয়াজ মানুষকে নাজেহাল করছে। ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন নিয়ে দ্রুত একটি মোটর সাইকেল সাঁই করে বেড়িয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ীগুলো অহেতুক উচ্চ আওয়াজের হর্ন বাজাচ্ছে। আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছে, হঠাৎ আকাশের বুক চিড়ে বিকট শব্দে জেটপ্লেন আকাশ দাপিয়ে বেড়ালো। লঞ্চের ক্রমাগত ভেঁপুর প্রতিযোগীতা, ট্রেনের শব্দ এগুলি সবই শব্দ দূষনের জন্য দায়ী। মাইক জোরে বাজানো, পিকনিক ও বিয়ে বাড়ির সাউন্ড বক্স পরিবেশকে অসহনীয় করে তোলে। কলকারখানার যান্ত্রিক আওয়াজ, জেনারেটরের একঘেয়েমি শব্দ, এমনকি আমরা যদি উচ্চশব্দে রেডিও বাজাই, টেলিভিশন দেখি সেটাও শব্দদূষন ঘটায়। শব্দদূষন মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
পরিবেশ দূষনের বেশ কয়েকটি প্রকারভেদের অন্যতম হল শব্দ দূষন। একটু গুছিয়ে বললে, মানুষের সহন ক্ষমতার বাইরে যে সুর বর্জিত, কর্কশ শব্দ মানুষের শরীর ও মনের উপর প্রভাব ফেলে, অবাঞ্ছিত এ সকলই শব্দদূষন। এটা বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক। জীববৈচিত্রের ক্ষেত্রেও শব্দদূষনের মারাত্মক প্রভাব পড়ে। শব্দ দূষনের ফলে মানুষ তার শ্রবনশক্তি হারিয়ে ফেলছে। উচ্চরক্তচাপ, শিরঃপীড়া, মানসিক অসুস্থতা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, আত্মহত্যার প্রবনতা,হৃদরোগসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।শব্দদূষনের কারনে শিশু কিশোরদের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। এটা জাতির জন্য অশনী সংকেত। এই বিপুল বধির জনগোষ্ঠী জনসম্পদ হওয়ার বদলে একসময় রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাড়াবে। বিপুল অংকের চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে। শব্দদূষন মানুষের অসচেতনার বহিঃপ্রকাশ। আমরা অনেকেই জানিনা যে, শব্দদূষনের ফলে মানুষের কি ধরনের সমস্যা হতে পারে। যিনি শব্দদূষন করে চলেছেন তিনিও জানেন না যে এটা মারাত্মক অপরাধ। তাছাড়া এর কোন আইনি প্রতিকারও দৃশ্যমান নয়। শব্দদূষন রুখতে ২০০৪ সালে শব্দদূষন (নিয়ন্ত্রন) বিধিমালা প্রনয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়। দীর্ঘ যাচাই-বাচাই শেষে ২০০৬ সালে বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়। এই বিধিমালার আওতায় যানবাহনে ক্ষতিকারক হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো পুরাপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবং লংঘনের কারনে লাইসেন্স বাতিলেরও বিধান রাখা হয়েছে। বাস্তবে এর প্রয়োগ কদাচিৎ হতে পারে। ২০১৬ সালে পরিবেশ অধিপ্তরের আওতায় বিভিন্ন স্থানে স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে সচেতনামূলক সভা,আলোচনা করা হয়েছিল। সচিবালয়ের আশেপাশে ১২/১৩টি পয়েন্টে শব্দ পরিমাপ করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা ১২৫ ডেসিবল এর মত ছিল যা নির্দিষ্ট মাত্রার চাইতে অনেক বেশী। শব্দদূষনরোধে প্রয়োজনে যুগোপযোগি আইন করা যেতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে মানুষের শ্রবনের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবল।কিন্তু বাস্তবে ১০০ মাত্রারও বেশী বিকট শব্দ নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত সহ্য করে যেতে হচ্ছে।
সমগ্র বিশ্বের যেকোন শহরের জন্য আবাসিক এলাকার শব্দের মাত্রা দিনে সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবল,রাতে ৩৫ । শয়ন কক্ষের জন্য অনুমোদিত মাত্রা ২৫ ডেসিবল।অফিস আদালতে ৩৫ থেকে ৪০ আর হাসপাতালের জন্য অনুমোদিত শব্দ মাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডেসিবল।কিন্তু আমাদের বাস্তবতা এর ধারেকাছেও নেই।চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে ৭৮ থেকে ৮৫ ডেসিবল এর বেশী শব্দ স্বাস্থের জন্য সুস্পষ্ট ক্ষতিকর।টেলিফোন আবিস্কারক “আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল” এর সম্মানার্থে শব্দের প্রাবাল্য নির্ণায়ক এই এককের নাম ‘বেল’ রাখা হয়েছে।
ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক একাধিকবার এ বিষয়ে গবেষনা করে দেখেছে,শব্দদূষনের শিকার মার্কিন যুক্তরাষ্টের ১১ শতাংশ লোক তাদের শ্রবনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।আমাদের দেশে এমন কোন গবেষনার কথা জানা যায় না।তবে এ সংখ্যা অনেক বেশী হতে পারে বলে অনুমিত।
শব্দদূষনে আক্রান্তের সঠিক পরিসংখ্যান হওয়া উচিৎ। শব্দদূষন যে অপরাধ তা গণমাধ্যমে প্রচার,সকলকে সচেতন করা,আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হলে শব্দদূষনের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।শব্দদূষনরোধে সমাজের সকলেরই এ বিষয় এগিয়ে আসা উচিৎ।