3:09 pm , October 19, 2020
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দীর্ঘ দেড় বছর পর নগরীর কাশীপুরের ইছাকাঠিতে স্থাপিত আব্দুল্লাহ দারুস সালাম নুরানী হাফিজি ও কওমি মাদ্রাসার অডিট রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। অডিটে দর্জি ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অগ্রহনযোগ্য ভাউচারের হিসেবে ১২ লাখ ২৯ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমান পেয়েছে অডিট কমিটি। কিন্তু গ্রহণযোগ্য হিসেবে দর্জি ওমর ফারুক ওই মাদ্রাসা থেকে আত্মসাৎ করেছেন ৩৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। একই রিপোর্টে ওমর ফারুক মাদ্রাসার জমি নিয়ে জালিয়াতি করেন তার প্রমানও পান কমিটি। গত ৯ অক্টোবর জুম্মা নামাজে মুসুল্লীদের সামনে এ রিপোর্ট পেশ করে ওমর ফারুককে আত্মসাৎকৃত টাকা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং একই সাথে ওমর ফারুককে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কারের জন্য বল হয়। অডিট কমিটির প্রধান ছিলেন নগরীর ২৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ আহমেদ। এছাড়া অপর সদস্য হলেন : ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন আহমেদ, কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া, কাশীপুর স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মামুন অর রশিদ, কাশীপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হুমায়ুন কবির এবং মো. রফিক।
রফিক দর্জি ওমর ফারুকের লোক হিসেবে অডিটে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও এ অডিট মেনে নিয়ে তাতে স্বাক্ষর করেছেন। অডিট রিপোর্টে অগ্রহনযোগ্য ভাউচার/স্বাক্ষরবিহীন ভাউচার/চটি খাতা থেকে প্রাপ্ত আয় অনুযায়ী ছাত্র বেতন বাবদ ৬৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৪ টাকা, অগ্রহযোগ্য ভাউচারে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪০ টাকা, চটি খাতায় ১০ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৯ টাকা, স্বাক্ষরবিহীন ভাউচার থেকে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭০৩ টাকা, গ্রহনযোগ্য থেকে ৩৮ লাখ ৮২ হাজার ১৫০ টাকা। এছাড়া মাদ্রাসার মুতওয়াল্লী ছাদুল্লাহ সিকদার ও আহসান উল্লাহ নিয়াজ মারফত প্রাপ্ত ৭৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৪ টাকা। আয়-ব্যয়ের হিসেবে দর্জি ওমর ফারুক আত্মসাত করেছেন ১২ লাখ ২৯ হাজার ৮২৪ টাকা। আর গ্রহনযোগ্য প্রকৃত হিসাব থেকে প্রাপ্ত : ছাত্র বেতন বাবদ আদায় ৬৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৪ টাকা, হেফজ খানা থেকে আংশিক আয় ১ লাখ ৩ হাজার ২৬২ টাকা। এছাড়া মাদ্রাসার মুতয়াল্লী ছাদুল্লাহ সিকদার ও তার ছেলে আহসান উল্লাহ নিয়াজ মারফত প্রাপ্ত ৭৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৪ টাকা। ওই টাকা তারা তাদের আত্মীয়স্বজনের নিকট থেকে মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য এনেছিলেন। আয়-ব্যয়ের হিসেবে দর্জি ওমর ফারুকের দায়িত্বকালীন সময় ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ২২৬ টাকা আত্মসাৎ করেন। ৯ অক্টোবর আব্দুল্লাহ দারুস সালাম নুরানী হাফিজি ও কওমি মাদ্রাসা সংলগ্ন আব্দুল্লাহ জামে মসজিদে জুম্মা নামাজে অডিট কমিটির প্রধান কাউন্সিলর ফরিদ আহমেদ অডিট রিপোর্ট পড়ে শোনান। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে গ্রহনযোগ্য ব্যয় বিবেচনায় দর্জি ওমর ফারুকের নিকট ৩৪ লাখ টাকা জমা থাকার কথা। অগ্রহনযোগ্য হিসাব আমলে নিয়ে দর্জি ওমর ফারুককে ১২ লাখ ২৯ হাজার ৮২৪ টাকা আত্মসাৎ করায় তাকে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার এবং টাকা আদায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ করেন অডিট কমিটির ওই ছয়জন। সেখানে আরো জানানো হয়, ইছাকাঠীর বাসিন্দা মরহুম কোরবানী আলী আকনের ছেলে মো. ছাদুল্লাহ সিকদারের নামে দশমিক ০৩ জমি সাব কবলা দলিল মুলে ক্রয় করার জন্য দর্জি ওমরকে দয়িত্ব দেয়া হলে তিনি অনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে জনৈক সামছুল হক বেপারীর নামে দলিল করে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেন। অডিট রিপোর্টের সত্যতা স্বিকার করে কাউন্সিলর ফরিদ আহমেদ ও কাশীপুর স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মামুন অর রশিদ জানান, ওমর ফারুকের দায়িত্বকালীন সময়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে তাকে ১২ লাখ টাকা মাদ্রাসার তহবিলে জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া তাকে চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুতির বিষয়টি অডিট রিপোর্টে তুলে ধরা হয়। এর ব্যত্যয় হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন মাদ্রাসা কর্র্তৃৃপক্ষ। মাদ্রাসার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ নিয়াজ বলেন, অডিট কমিটির কাছে আমাদের দাবি রয়েছে গ্রহণযোগ্য হিসেব অনুযায়ী আত্মসাতকৃত ৩৪ লাখ টাকা আদায়ের। এরপরও অডিট কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছেন তা স্থানীয় মুসুল্লীসহ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছেন। এখন দর্জি ওমর ফারুক যদি স্ব-ইচ্ছায় টাকা না দেয় তাহলে আইনের আশ্রয় যাবেন তারা। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন আইনে মামলা দায়েরের কথা জানান তিনি। তবে এ অডিট মানতে নারাজ দর্জি ওমর ফারুক। তার দাবি অডিট সঠিক হয়নি। তিনি আবারো অডিটের দাবি জানান। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে মুতওয়াল্লী মো. ছাদুল্লাহ সিকদার মাদ্রাসার জন্য ৩ শতাংশ জমি দান করেন। মাদ্রাসার শুরুর পর ২০১৫ সালে মসজিদ ও মাদ্রাসার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে মৌখিকভাবে পরিচালনার এবং দানকৃত জমির দলিল করার জন্য ওমর ফারুককে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ওমর ফারুক সেখানে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিজেকে জমির দাতা হিসেবে উপস্থাপন এবং মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা দাবি করে আসছিলেন। এছাড়া ওমর ফারুকের দায়িত্বকালীণ সময় সঠিক রেজুলেশন না করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অমান্য করে মাদ্রাসার আয়-ব্যয়, দান-অনুদান, হিসাব-নিকাশ, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে তার বিরুদ্ধে টাকা লেনদেনর অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া মাদ্রাসায় কোনভাবেই দান গ্রহণ করার নিয়ম না থাকলেও ওমর ফারুক বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট দানের টাকা এনে তা বছরের পর বছর ধরে হজম করে আসছিলেন। এমনকি বেশীরভাগ দানের অর্থের হিসাব খাতায় লেখা হতো না। ওমর ফারুক মুতওয়াল্লী ছাদুল্লাহ সিকদারের পারিবারিক ঝামেলা, শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা ও বয়সকে কাজে লাগিয়ে যে কোন রেজুলেশনে স্বাক্ষর আদায় করতেন। বিভিন্œ সময় বিষয়টি ধরা পড়ার পরও তিনি তার দুর্নীতি জায়েজ করতে ওই পন্থা অবলম্বন করতেন। এরপরও রেজুলেশন খাতায় ফাক রেখে মুতওয়াল্লীর স্বাক্ষর পরবর্তী সেখানে নতুন লেখা ঢোকানোর প্রমান মিলেছে। তাছাড়া মাদ্রাসার হেফজ খানায় এতিম ও লিল্লাহ বলে কিছু নেই। শিক্ষার্থীরা মাসিক টিউশনি ফি দিয়ে লেখাপড়া করছে। কিন্তু ওমর ফারুক লিফলেটে এতিম ও লিল্লাহ ছাপিয়ে কুরবানীর চামড়া থেকে শুরু করে যাকাত ও দান-অনুদান গ্রহণ করতেন। ওই টাকায় তার নিজের পকেট ভারী করে আসছিলেন ওমর ফারুক। বর্তমানে মাদ্রাসার নার্সারী থেকে শুরু করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জামাত, প্লে ও নার্সারী এবং হেফজখানায় ২৭৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ৬ জন শিক্ষক দিয়ে তাদের ক্লাস পরিচালনা করা হয়।