3:03 pm , September 25, 2020
সামান্য বৃষ্টিতে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়া, অধিকাংশ সড়ক পানির নীচে চলে যাওয়া,বাসা -বাড়ি, দোকানপাটে পানি প্রবেশ করা,যানবাহন চলাচলে বিপত্তি,সবকিছু মিলে নগরবাসীর জীবন
দুর্বিষহ,ভোগান্তি যেন পিছু ছাড়ছে না। অতিবৃষ্টি আর উত্তরের ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যা এই আলোচনার বাইরে।
কিন্তু কেন এই দুর্ভোগ ? বিশ্লেষণধর্মী,বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে নয়, নগরীর একজন সাধারন বাসিন্দা হিসাবে যা চিহ্নিত করা যায়।
প্রথমত,অপরিকল্পিত নগরায়ন।
বরিশাল জেলা কে যখন বিভাগে উন্নিত করা হয়, তখন থেকেই বরিশাল নগরে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পদ্মাব্রীজ,পায়রা গভীরসমুদ্রবন্দর,কুয়াকাটার কারনে বরিশাল এখন অনেকের কাছেই আকর্ষণীয়। অনেকটা অপরিকল্পিত ভাবে যেখানে সেখানে ভবন/অবকাঠামো নির্মানের ফলে কৃষি জমি,পুকুর, প্রাকৃতিক জলাধার সমূহ ভরাট হয়ে পড়েছে। এখনও তা অব্যাহত আছে। দ্বিতীয়ত, বিল্ডিংকোড মেনে ভবন নির্মান করা হচ্ছে না। ভবনের চতুর্দিকে যতটুকু স্থান ফাকা রাখা বাধ্যতামূলক তার অন্তত ২৫% ভাগ খোলা রাখার নিয়ম।অর্থাৎ,খোলা স্থানটুকু কংক্রিট দিয়ে ঢাকা যাবে না।খোলা স্থান দিয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।নিয়ম মেনে ভবন তৈরী করা হয়েছে এমন সংখ্যা হাতে গোনা। নির্মিত ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থা করা হয় না। ছাদে এবং ভবনের নিচে আঁধারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন ব্যবস্থা থাকলে জলাবদ্ধতা অনেকটা নিয়ন্ত্রনে থাকবে , একই সাথে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের উপর চাপ কমে আসবে।এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভবনের উঠান খালি রাখলে বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতা ৬০ ভাগ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব । দূর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাঃ বরিশাল নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এর ব্যবহার উপযোগিতা নাই বললেই চলে। অনেকটা অবৈজ্ঞানিকভাবে, অপরিকল্পিত ভাবে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তৈরী করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মাস্টার ড্রেনের সাথে প্রাইমারী ড্রেনের সংযোগ নাই,থাকলেও তলদেশের উচ্চতার পার্থক্য থাকায় পানি নিষ্কাশন হয় না।নবগ্রাম রোডের খাল ভরাট করে মার্কেট নির্মান, নগরীর জন্য আত্মঘাতী হয়েছে। জোয়ার এবং বৃষ্টিতে এখানে সবার আগে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।খালের উপরের ব্রিজ ভেঙে কালভার্ট নির্মান করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।ড্রেনের নীচে মাঝেমাঝে ঢালাই না করে ফাকা রাখার নিয়ম উপেক্ষিত। কংক্রিটের স্তর না থাকলে পানি মাটি চুইয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করে পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে।
নগরীর মধ্যে এক সময় ২৩টি খাল এবং ২৪টি সংযোগ খাল প্রবাহিত হত বলে জানা যায় তন্মধ্যে অন্তত ২৪টি খালের অস্তিত্ব নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে ছোট ছোট ড্রেন বানানো হয়েছে। যে ২২/২৩ টি খালের কথা বলা হয় সেগুলি দখল,দূষণ এবং নাগরিকগনের অপরিণামদর্শী আচরনের কারনে নিভুনিভু ভাবে বেঁচে আছে। মাত্র ৩/৪ টি খালে জোয়ার ভাটা হয়।খালের উপর নীচ অপচনশীল বর্জ্য বিশেষত প্লাস্টিক এবং পলিথিনের পুরু স্তর জমা এবং দুই পাড়ের বাসিন্দাদের অপদখলের কারনে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এইসব খালের ব্যবহার উপযোগীতা নাই। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে খালগুলি কোন ভূমিকা রাখতে পারছেনা। অথচ এক সময় জেলখাল, নবগ্রাম খাল,সাগরদী খালে স্রোত ছিল। বড় বড় নৌকা মালামাল পরিবহন করত, গয়না যাত্রী নিয়ে আসা যাওয়া করত। খালে মাছ ধরে অনেকে জীবিকানির্বাহ করত, সবই এখন ইতিহাস। নবগ্রাম খালটি বটতলা এলাকায় পাকা ড্রেন । নবীন প্রজন্মের কাছে মনে হবে এগুলি শুধুই গল্প। সম্প্রতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব কর্মী এবং অর্থায়নে জেলখাল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য,জেল খাল থেকে উঠে আসছে শতমণ পলিথিন আর প্লাস্টিক বর্জ্য।এই তথ্য নাগরিকগনের জন্য কোন ভাল বার্তা নয়। আমাদের প্লাস্টিক এবং পলিথিন ব্যবহার ত্যাগ করে পাটের ন্যায় পচনশীল এমন দ্রবাদি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে। সস্তায় পাটের গার্বেজ ব্যাগ উৎপাদন এবং প্রাপ্যতা সহজ লভ্য করে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তাছাড়া আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে দূরে থাকার আর সময় নাই।
একসময় নগরীতে তিনহাজারের বেশী পুকুর ছিল আর এখন হাতে গোনা কিছু সংখ্যক পুকুর আছে। তাও আবার মাঝেমধ্যে গোপনে ভরাট করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভাটিখানায় একটি পুকুর রাতের আঁধারে বালি ফেলে একাংশ ভরা হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি পুকুর,জলাশয় ভরাটের ফলে বৃষ্টির পানি উপচে উঠে বাসা বাড়ি, দোকানপাট,রাস্তাঘাট ডুবিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি জনজীবন এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত আশংকাজনক।পুকুর, জলাশয় ভরাট করার প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে অচিরেই আমরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হব। ব্যক্তি তাঁর জীবনের প্রয়োজনে পুকুর ভরাট করে। তাকে বাসস্থান বানাতে হবে, ব্যবসা বানিজ্য করতে হবে, কাজেই তাঁকে নিবৃত্ত করা কঠিন। অন্য দিকে রাষ্ট্রকে এগুলো রক্ষা করতেই হবে, কোন বিকল্প নাই। প্রয়োজনে এগুলি সরকারি অর্থায়নে ক্রয় করে সংরক্ষন করতে হবে। জলবায়ূ বিপর্যয়ের কারনে, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে মেরু অঞ্চলের গ্রীনল্যান্ড, আর্কটিক, এন্টার্কটিকা এবং হিমালয়ের বরফগলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা স্থায়ীভাবে বেড়ে যাচ্ছে।এরই ধারাবাহিকতায় জলোচ্ছ্বাস,উঁচু জোয়ারের প্রভাবে নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে দুকুল প্লাবিত করছে।নদীর পানির উচ্চতা বেশী হওয়ায় নগরীতে বৃষ্টিতে জমা হওয়া পানি খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীতে নামতে পারছেনা। নদীর পানির উচ্চতা না কমা পর্যন্ত শহরে জলাবদ্ধতা থাকছে।নদী ব্যবস্থাপনায়ও জনগন খুশী নয়। ড্রেজিং করে সেই বালি নদীতেই ফেলা হচ্ছে। নদীর তলদেশে পলি জমে নাব্যতা হ্রাস নগরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারন।নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির ধারন ক্ষমতা কমে গেছে।
এখন প্রশ্ন এভাবে কতকাল চলবে? নাগরিক ভোগান্তির কি শেষ নাই? প্রাচ্যের ভেনিস কি তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে?
জবাব খোঁজার চেস্টা করা হয়েছে।
আপাতত যা দেখা যাচ্ছে :-
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের “প্রিপারেশন অব ডেভেলপমেন্ট প্লান ফর বরিশাল ডিভিশনাল টাউন” শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই মহা পরিকল্পনা গেজেট আকারে প্রকাশিত।প্রকল্পের মেয়াদকাল (২০১০ -২০৩০)। এই প্রকল্পে খাল সমুহ দখলমুক্ত,সংরক্ষন ও বিনোদন সুবিধা সম্বলিত ডিটেইলড এরিয়া প্লান প্রনয়ন করা হয়েছে। শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ পরিকল্পনা এবং একই সাথে প্রাইমারী -সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি এই তিন শ্রেণীতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। অতিবৃষ্টিতে যেন শহর তলিয়ে না যায় সে কারনে জলাধার সংরক্ষনের উপর জোর দেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় শহরের পুকুর সংরক্ষনের কথা বলা আছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ইতিপূর্বেই
খাল সংরক্ষন এবং আধুনিকায়নের জন্য প্রায় ২৫০০কোটি টাকার প্রকল্পের প্রস্তাব প্রেরন করেছে।
তবে বন্যা এবং নদীর জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে নগরীর নি¤œাঞ্চল, রাস্তাঘাট, নীচুঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া, আর বৃষ্টির পানি নামতে বিলম্ব হওয়ার সমাধান আপাতত দৃশ্যমান নয়। তবে এটা অশনিসংকেত,বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় এলাকার জন্য।মূলত এটা বৈশ্বিক সমস্যা।এটা জলবায়ূ পরিবেশ বিপর্যয়ের আলামত নয়ত! আমাদের এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।
আমরা পরবর্তি প্রজন্মের জন্য আশাবাদী থাকতে চাই।
কাজী মিজানুর রহমান
জলবায়ু ও পরিবেশ কর্মী।
সভাপতি
সবুজ আন্দোলন।