2:04 pm , September 18, 2020
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ আশ্বিনের মূল প্রজনন মৌসুমকে সামনে রেখে দক্ষিণ উপকূলের সাগর মোহনায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী ডিমওআলা মা ইলিশের বিচরন ও আহরনে আগামী বছর উৎপাদন নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের মাঝে। আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে আশি^নের বড় পূর্ণিমার অগে পড়ের ২২ দিন নিরাপদ প্রজননের লক্ষে সারা দেশে ইলিশ আহরন বন্ধ থাকবে। গতবছরও ভাদ্রের মধ্যভাগের পরেই সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ উপকূল সহ দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে উঠে আসায় ব্যাপকহারে জালে ধরা পরে। তবে এবার এখনো সাগরের ইলিশ অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে উঠে না এলেও উপক’লীয় মোহনায় ব্যাপক বিচরনে তা ধরা পড়ছে। জেলে ও মৎসজীবীদের মতে, এবার দেশের উত্তর ও মধ্যঞ্চলে বণ্যা সহ ভাদ্রের বড় অমাবশ্যায় ফুসে ওঠা সাগরের ভয়াল জোয়োরের প্লাবনে সমগ্র দক্ষিঞ্চল প্লাবিত হয়। সেসব পানি প্রবল বেগে সাগরে পতিত হবার কারনে ইলিশ এখনো দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে উঠে আসছে না। তবে অসন্ন প্রজননকালের আগেই যদি উত্তর বঙ্গোপসাগর থেকে মা ইলিশ উপকূল হয়ে অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে উঠে আসতে শুরু করে, তবে তা আরো বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে বলেও শংকিত মৎস্য বিজ্ঞানীগন। মূল বর্ষা মৌসুমে কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় সাগরে পানির উষ্ঞতা বৃদ্ধির ফলে মা ইলিশ আগাম উজানে ছুটে আসছে বলে একাধীক মৎস্য বিজ্ঞানী মনে করলেও এলক্ষে ব্যপক গবেষনার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশ মেনেই সরকার আশ্বিনের প্রথম উদিত চাঁদের পূর্ণিমার আগের ৪ দিন ও পরের ১৭ দিন সহ মোট ২২দিন ইলিশের মূল প্রজননকাল হিসেবে চিঞ্হিত করে উপকূলের ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মূল প্রজননস্থলে সবধরনের মাছের আহরন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। পাশাপাশি সারাদেশের নদ-নদীতে ইলিশ আহরন ছাড়াও এর পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকবে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২-১৩%। বিগত দুই দশকে ইলিশ নিয়ে নানামুখি পদক্ষেপের ফলে এর উৎপাদন ১.৯৮ লাখ টন থেকে ইতোমধ্যে সোয়া ৫ লাখ টন অতিক্রম করেছে। যারমধ্যে মূল প্রজননকালীন ২২ দিন সময়ে আহরন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকার বিষয়টি ছাড়াও জাটকা আহরন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা অন্যতম প্রধান ভ’মিকা পালন করছে। ২০১৫ সালে আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে পড়ে ইলিশ আহরন নিষিদ্ধকালীন সময় ১৫ দিনের স্থলে ২০১৭ সালে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। ফলে এসময়ে ইলিশের নিষিক্ত ডিমের পরিমান ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬৫ কেজি থেকে ৩৭% বেশী, অর্থাৎ ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৫ কেজিতে উন্নীত হয়। এমনকি ইলিশ পোনা জাটকার উৎপাদনও ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২ হাজার ২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সারা বিশ্বে উৎপাদন হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে গত দেড় দশকে ইলিশ উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭৫% বাংলাদেশে, ১৫% ভারত ও মায়নামারে এবং থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইরান ও ইরাকে অবশিষ্ট ইলিশ উৎপাদিত হয়ে থাকে। তবে গত বছর দেশে যে প্রায় সোয়া ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে, তার ৭০ ভাগই পাওয়া গেছে বরিশালে বিভাগের অভ্যন্তরীন ও উপকূলীয় জলাশয় থেকে। বরিশাল বিভাগে ইতোমধ্যে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০%-এরও বেশী। অভিপ্রায়নি মাছ ইলিশ সারা বছর কমবেশী ডিম ছাড়লেও আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পড়েই গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলের সাগর মোহনার ৪টি এলাকার প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে ডিম ছেড়ে আবার সাগরে ফিরে যায়। কিন্তু এবার ভাদ্রের মধ্যভাগ থেকে সাগর মোহনার নদ-নদীতে ইলিশের উপস্থিতি মৎস্য বিজ্ঞানী সহ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলদের কিছুটা ভাবনায় ফেলেছে। গত দিন দশেক ধরেই মেঘনা, তেতুলিয়া, বলেশ^র ও আন্ধারমানিক সহ উপক’লের বিভিন্ন নদ-নদীর সাগর মোহনায় মা ইলিশের ব্যাপক বিচরনে জেলেদের জালে ধরাও পড়ছে। তবে এবার করোনা সংকটে দক্ষিণাঞ্চল সহ সারা দেশেই চাহিদা কিছুটা কম থাকায় জেলেরা দাম না পেলেও গত সপ্তাহ থেকে ভারতে পুনরায় রপ্তানী শুরু হওয়ায় বাজারে এক কেজি সাইজের ইলিশের দাম বেড়েছে। বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও পিরোজপুরের ইলিশের মোকামগুলো গতদিন পনের কিছুটা স্বরব হলেও বেচকেনা অন্য বছরের তুলনায় কম বলে জানিয়েছেন একাধীক মৎসজীবী। পাশাপাশি আর দিন কুড়ি পরেই আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পড়ের ২২ দিন ইলিশ আহরন ও বিপনন বন্ধ হয়ে যাবে বিবেচনায় আড়তদাররা জেলেদের খুব একটা দাদন বা আগাম টাকাও ছাড় করছে না। ফলে টাকার অভাবে বরফ, জ¦ালানী ও দৈনন্দিন খরচ সংকুলন না হওয়ায় সাগর মোহনায় ছুটে ইলিশ আহরনে ততটা উৎসাহিত হচ্ছে না জেলেরা। এর পরেও প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলের আড়তগুলোতে নুন্যতম ১শ থেকে ৩শ টন পর্যন্ত ইলিশ নিয়ে ট্রলার আসছে। যার বেশীরভাগই মা ইলিশ। মৎস অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক, মূল প্রজননকালের আগে অধিকহারে মা ইলিশ সাগর থেকে উঠে আসাকে ভাল লক্ষন নয় বলে মন্তব্য করলেও তেমন কিছু করনীয় নেই বলেও জানিয়েছেন।