দক্ষিনাঞ্চলে ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রমে বিলম্ব দক্ষিনাঞ্চলে ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রমে বিলম্ব - ajkerparibartan.com
দক্ষিনাঞ্চলে ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রমে বিলম্ব

3:23 pm , September 14, 2020

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বর্ষা বিদায়ের লগ্নে উজানের ঢলের প্রবল স্রোতে নদ-নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের একাধিক জনপদ। সীমান্তের ওপারসহ দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ৭৫ ভাগ পানি সাগরে নিয়ে যাবার মুখে এ অঞ্চলের ছোট বড় নদ-নদী গ্রাস করছে মানুষের ভিটেমাটিসহ সরকারীÑবেসরকারী স্থাপনা। সর্বশান্ত হচ্ছে দক্ষিণ জনপদের হাজার হাজার পরিবার। নদ-নদীবহুল দক্ষিনাঞ্চলের কোটি মানুষের বেশীরভাগের সাথেই নদী জড়িত। অনন্তকাল থেকে বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের ভাঙাÑগড়ার খেলা চলছে নদীর সাথে। নদী তাদের অনেক কিছু দিলেও আবার করছে সর্বশান্ত। এখনো নদী ভাঙনে ‘সকাল বেলার আমীর ফকির সন্ধা বেলা’। কিন্তু এর পরেও নদী ভাঙন রোধে দ্রুত প্রকল্প গ্রহন থেকে বাস্তবায়ন হচ্ছে না দক্ষিণঞ্চলে। এমনকি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙন রোধে কোন সমন্বিত নিবিড় কর্মসূচীও গ্রহন করা হয়নি। যেসব প্রকল্প অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন লাভ করে তার বাস্তবায়নও হয় বিলম্বিত। এমনকি অর্থের অভাব সহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নদী ভাঙন রোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন এখনো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বেড়াজালে। সব ধরনের জটিলতা এড়াতে পরিকল্পনা গ্রহণ, পরিবীক্ষণ এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণ সহ জন প্রতিনিধিদের যুক্ত করারও দাবী উঠেছে। বরিশালে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ‘কোষ্ট’ আয়োজিত “জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল উপকূলীয় বাঁধ নির্মান ও টেকসই নিরাপত্তায় প্রয়োজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংস্কার” শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা নদী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে বোর্ড যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না বলে জানান হয়েছে। বরং পাউবোর প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জনবল সংকট এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মান ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারার দাবী করা হয়েছে সেমিনারে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ৪৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ চাহিদার বিপরিতে পাওয়া যায় মাত্র ৪১ কোটি টাকা। ফলে বাঁধ সংস্কার সহ নদী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না বলেও বোর্ডের তরফ থেকে দাবী করা হয়েছে। দক্ষিনাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে নদ-নদীর ভাঙন রোধ সহ নদী শাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোপূর্বে ৩১টি প্রকল্প মন্ত্রনালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করলেও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু প্রকল্প অনুমোদন লাভ করলেও অর্থ ছাড়ের অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন শ্লথ হয়ে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে টেকসই নদী ভাঙন রোধ সহ বণ্যা নিয়ন্ত্রন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন পাঁচ সহস্রাধিক কোটি টাকা। বেশ কিছু নদী শাষন ও ভাঙন রোধ প্রকল্প যাচাই-বাছাই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী এখনো পুণঃগঠন পর্যায়ে রয়েছে। কিছু প্রকল্প-প্রস্তাবনা ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট’ তহবিলের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আবার কিছু প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন সহ অধিকতর যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্প কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনাধীন বলেও জানা গেছে। আবার কিছু প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের প্রি-একনেক’এর বিবেচনায়। কয়েকটি প্রকল্প-প্রস্তাবনা বিবেচনা না করেই ফেরত দেয়া হয়েছে বোর্ড থেকে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে বরিশাল জেলার ৮টি স্থানে নদীভাঙন রোধে প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা, পটুয়াখালীর ৩টি নদী ভাঙন রোধ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা, ভোলায় মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর ভাঙন থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রক্ষায় ৮টি প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও কালিজিরা নদীর ভাঙন থেকে নৌ বাহিনীর আঞ্চলিক বেজ স্টেশন সহ ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা এবং বরগুনার ৩টি প্রকল্প বাস্তায়নে ৪২৭ কোটি টাকার প্রকল্প-প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রণালয় সহ পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এছাড়াও পিরোজপুর জেলার দুটি প্রকল্পের জন্যও প্রায় ৫৪ কোটি টাকা প্রয়োজন। তবে জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার এ দুটি প্রকল্প জিওবির তহবিল সহ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে সুগন্ধা নদীর ভাঙন থেকে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের দোয়ারিকাতে ‘বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু’ ও সংযোগ সড়ক রক্ষায় প্রায় ৮ বছর আগে ১১ কোটি টাকার প্রকল্পÑপ্রস্তাব অনুমোদন না হওয়ায় এখন প্রয়োজন হবে প্রায় ২৩৫ কোটি টাকা। এ সংক্রান্ত প্রকল্পÑপ্রস্তাবনাটি আরো প্রায় ১০ মাস আগে একনেক-এর চুড়ান্ত অনুমোদন লাভ করলেও এখনো দরপত্র পর্যায়ে। ২০১৭-এর নভেম্বরে বরিশাল মহানগরী সংলগ্ন চরবাড়ীয়া এলাকার কীর্তনখোলা নদীর ভাঙন রোধে ৩৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেক-এর অনুমোদন লাভ করলেও তার বাস্তবায়নও বিলম্বিত হচ্ছে একর পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে অর্থ সংকটে। প্রকল্পটি নৌ বাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় না করায় প্রকল্পের কাজ কাঙ্খিত মাত্রায় এগুচ্ছে না। গত অর্থবছরে প্রকল্পটির জন্য ৫০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৫ কোটি টাকারও কম। মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, বিষখালী ও পায়রা সহ বড় নদ-নদী গুলো উজানের পানি সাগরে নিয়ে যাবার পথে গ্রাস করছে দক্ষিণাঞ্চলের একের পর এক জনপদ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসমুহ। কিন্তু তার প্রতিরোধ কার্যক্রমে এখনো যথেষ্ঠ ধীর গতি। অতি সাম্প্রতিক প্লাবন আর উজানের ঢলের পানিতে সয়লাব দক্ষিণাঞ্চলের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যাবার পথে নদ-নদীগুলোর ভাঙন আরো তীব্রতর হয়েছে। বরিশালে মেঘনা পাড়ের মেহেদিগঞ্জের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সরকারীÑবেসরকারী স্থাপনাও নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। একই অবস্থা বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ ও বিমানবন্দরের উত্তর প্রান্তের সুগন্ধা নদী তীরের মানুষের। সুগন্ধার বুকে বিলীন হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর উজানে একটি স্কুল ভবন ও মসজিদ। কুয়াকাটা সাগর সৈকত ক্রমশ সংকুচিত হয়ে উপকূলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আঘাত হানলেও গত দশ বছর ধরে শুধু নানা ধরনের গবেষনা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অতিসম্প্রতি পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম সরেজমিনে কুয়াকাটা পরিদর্শন করে ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভোলায় ভাঙন রোধে একাধীক প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তব কার্যক্রম শুরু হলেও অর্থের অভাবে ক্রমশ তা গতি হারাচ্ছে। গোটা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নদী ভাঙনে সর্বশান্ত মানুষের আহাজারী।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT