3:41 pm , August 31, 2020
কাজী ফিরোজ ॥ উন্নত, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলির অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরনের কারনে বাংলাদেশ বেশী ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় আছে। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরনের ফলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে পৃথিবীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রবল বেগে ঢুকে পড়ছে সূর্যের অতি বেগুনী তেজস্ক্রিয় রশ্মি। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগতভাবে প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।এর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্প্রসারনের ফলে বাড়ছে কার্বন নিঃসরনের পরিমান, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা।বৈশ্বিক উষ্ণতার সাথে পাল্লা দিয়ে,বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। এতে করে ঝুঁকির মুখে পড়ছে সমুদ্র উপকূলের দেশগুলি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ খৃস্টাব্দ নাগাদ লবনাক্ত পানিতে তলিয়ে যাবে উপকূলীয় প্রায় ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। এতে প্রায় ৬ কোটি মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ গুলির তালিকায় বাংলাদেশকে উপরের দিকে রাখা হয়েছে, অথচ কার্বন নিঃসরনে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই নগণ্য। বিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১০ -১২ সেন্টিমিটার। ২১০০ খৃস্টাব্দ নাগাদ আরো ১৮ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়লে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলীয় দেশ বাংলাদেশও। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সবুজ সুশোভিত ষড়ঋতুর দেশ নামে খ্যাত বাংলাদেশের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেমনি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে তেমনি ঠান্ডাও অনুভূত হচ্ছে কম। শীত ব্যতীত অন্যসব ঋতুর আমেজ উপভোগ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিলম্বিত হচ্ছে শীত,বর্ষার আগমন অথবা অসময় ভারী বর্ষন কিংবা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানী ডঃ নারম্যান ম্যাকলিয়ও যিনি দীর্ঘকাল সাহারা মরুভূমি নিয়ে গবেষণা করেছেন -তিনি জানিয়েছেন সাহারা মরুভূমি যেভাবে মরুকরণের দিকে এগোচ্ছে ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাতাসেও সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মত আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া তাৎক্ষনিক ভাবে ঘটে না, খুব ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়। অর্থাৎ, একবার মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলে এটি পরিপূর্নতা পেতে অর্ধশতাব্দী বা তার ও বেশী সময় পেরিয়ে যায়। নঁওগা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়া মরুময়তার লক্ষণ অন্যসব এলাকার তুলনায় বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। বড় বড় শিল্প কারখানা, পারমানবিক চুল্লি নির্মান, তেল, কয়লা,গ্যাস ব্যবহার, নির্বিচারে বন উজাড়, নদী শাসন ইত্যাদির ফলে নিদারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে।মেরু অঞ্চলের বড় বড় বরফের চাই গলে একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে,অন্যদিকে পর্যাপ্ত জলের অভাবে অন্য এলাকা মরুকরণ হচ্ছে। যার অন্যতম প্রধান শিকার হচ্ছে আমাদের মাতৃভূমি প্রিয় “বাংলাদেশ”। এছাড়া দুইমেরুর বরফ গলার ফলে ২০৫০ খৃস্টাব্দ নাগাদ বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল, মালদ্বীপ, মুম্বাই, ইন্দোনেশীয়,সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি,মার্শাল আইল্যান্ড, মিশরের বদ্বীপ অঞ্চল, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ভিয়েতনামের উপকূলীয় শহর তলিয়ে যাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দুভাবেই আক্রান্ত হচ্ছি আমরা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিনত হতে যাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের মিঠাপানির অন্যতম উৎস হিমালয়, শীতকালে হিমালয় পর্বতে বরফ জমে আর গ্রীষ্মকালে এই বরফ গলে আমাদের নদীতে আসে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে হিমালয়ে পর্বতে যখন বরফ জমবেনা, তখন মিঠাপানির গভীর সংকট তৈরী হবে। এই প্রেক্ষাপটে ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৮ খৃস্টাব্দে বাংলাদেশে “সবুজ আন্দোলন” নামে একটি অরাজনৈতিক পরিবেশবাদী সামাজিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। জার্মান প্রবাসী একজন দেশপ্রেমিক শাহাবুদ্দিন মিয়ার পরিকল্পনা ও অর্থায়ন এবং একাধিক যুব -তরুন -বয়োজ্যেষ্ঠ সংগঠকের পরিশ্রমে এটি প্রতিষ্ঠা পায়। বাপ্পি সরদারও এদের মধ্যে একজন, তবে বর্তমানে তিনি অন্য একটি সংগঠন পরিচালনা করছেন। আজ সংগঠনটি তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে। সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সফলতা কামনা করছি।এই সংগঠনের উদ্দেশ্য হল সরকারের সহায়ক শক্তি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষকে জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত করানো এবং উন্নত দেশগুলি যারা মূলত এই সংকটের জন্য দায়ী তাদের কাছ থেকে ভর্তুকি আদায় করা এবং এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া,যেমন দরকষাকষির সক্ষমতা অর্জন। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়ার বিষয় গবেষনা শুরু করা। এমন দিনে আমাদের আহবান সবুজ আন্দোলনে যোগ দিন, পরিবেশ বাঁচাই, দেশ বাঁচাই, বিশ্ব বাঁচাই। সবুজ আন্দোলনের শ্লোগান হল “খনিজ জ্বালানীর ব্যবহার বন্ধ করুন। পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষা করুন। “
জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসাবে জাতিসংঘ ও শিল্পোন্নত রাস্ট্রের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে ক্ষতিপূরনের দাবী সমুহ —
১) অনতিবিলম্বে সারা পৃথিবীর কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান বন্ধ করা এবং ২০৩০ খৃস্টাব্দের মধ্যে অর্ধেক ও ২০৫০ খৃস্টাব্দের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। ২)বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানী সেক্টরে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে শিল্পোন্নত দায়ী রাষ্ট্রকে বাধ্য করা। সোলার সিস্টেম এবং দেশের সমুদ্র উপকূল ও নদীর পাড়সমূহে উইন্ড পাওয়ার প্লান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহযোগীতা করা। প্রতিবেশি দেশগুলির সাথে যৌথভাবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করা। ৩)বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও বড় নদীর পাড় জুড়ে নেদারল্যান্ড এর মত টেকসই বেড়ীবাঁধ নির্মান এবং মিঠাপানি সংরক্ষনের জন্য নদী ও দিঘি খনন করতে অর্থ বরাদ্দ দিতে দায়ী রাষ্ট্রকে বাধ্য করা। ৪)সুন্দরবনের আশেপাশে সকল ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা এবং আগামিতে যেন কোন স্থাপনা নির্মান করতে না পারে তার জন্য আন্তজার্তিক ভাবে আইন পাশ করতে হবে। সারা দেশে সামাজিক বনায়নে অর্থ বরাদ্দ দিতে দায়ী রাষ্ট্রকে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ৫) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সম্ভাব্য ছয় কোটি বাস্তুহারা মানুষের পূনর্বাসনের পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করতে দায়ী রাষ্ট্রকে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। ৬) বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ রোধে বাংলাদেশ সরকারকে কারিগরি সহায়তা ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে দায়ী রাষ্ট্রেকে উৎসাহ দেওয়া। ৭) প্রত্যেক সিটি কর্পোরেশন, জেলা শহর ও পৌর এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পাঞ্চল এলাকার বর্জ্য অপসারণ, ই -বর্জ্য রাখার জন্য প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে ডাম্পিং স্টেশন নির্মান করা এবং বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনেরজন্য দায়ীরাষ্ট্রকে অর্থ বরাদ্দ দিতে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। আমাদের উচিত হবে উন্নত দেশগুলো যারা এই সংকটের জন্য মূলত দায়ী তাদের কাছ থেকে ভর্তুকি আদায় করা, এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য এখন থেকেই প্রস্ততি নেয়া।