3:38 pm , August 22, 2020
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ কৃষিনির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের করোনা সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাড়ানোর প্রচেষ্টার মধ্যে ভাদ্রের অমাবশ্যার ভড়া কোটালে ভর করে ফুসে ওঠা সাগরের জোয়ার আর উজানের ঢলের সাথে অবিরাম বর্ষনে প্রায় সকল কৃষি জমিই সয়লাব হয়ে গেছে। কৃষিÑঅর্থনীতিকে সচল রাখতে কৃষিযোদ্ধাদের সব পরিশ্রমই প্রকৃতির রুদ্র রোশের কাছে ব্যার্থ হতে চলেছে। গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষন আর জোয়ারে সয়লাব হয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমির উঠতি আউশ ধান ছাড়াও সদ্য রোপা আরো সোয়া লাখ হেক্টর জমির আমন ধান। ফরিদপুর অঞ্চলের ৫টি জেলায়ও প্রায় ৩৭ হাজার হেক্টর আউশ, আমন, পাট,তিল,কলা সহ বিভিন্ন সবজি ইতোমধ্যে বণ্যার পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ফসলি জমিতে চোখ রাখলে এখন শুধু পানি আর পানি। এ প্লাবনে আরো অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমির শাক-সবজি থেকে অন্যন্য ফসলও নিমজ্জিত হয়েছে। বিগত রবি মৌশুমে বোরো, গম, তরমুজ ও শাক-সবজি উৎপাদনে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকগন। গত নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর পরে মে মাসে আরো ভয়াল ঝড় ‘আম্পান’ দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বিপর্যস্ত করে দিলেও দমে থাকেন নি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধাগন। উপরন্তু এবার ভরা বর্ষায় দক্ষিণাঞ্চলে কাঙ্খিত বৃষ্টি না হলেও বুলবুল ও আম্পানে ভর করে অসময়ের অতিবর্ষণ কৃষি ব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড করে দেয়। এরপরে গত মার্চের শেষ ভাগ থেকে করোনা সংকট কৃষি ব্যবস্থায় যথেষ্ঠ বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করলেও দমে থাকেননি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকগন। কিন্তু ভাদ্রের বড় অমাবশ্যায় সাগর ফুসে ওঠার সাথে উজানের বণ্যার পানি সাগরমুখি হবার পথে দক্ষিণাঞ্চলকে সয়লাব করে দিচ্ছে। সাথে অবিরাম বর্ষণ। গত ৪ দিনের টানা বর্ষণ আর জোয়ারের প্লাবনে গোটা দক্ষিনের জনপদ এখন পানির তলায়। এক ইঞ্চি জমির ফসলও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। উঠতি অউশের সাথে রোপা আমন আর আমন বীজতলার পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশংকায় অস্থির কৃষকগন। তবে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই’র বরিশাল কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জানান, আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। যত দ্রুত পানি সরে যায় তত ভাল। পানি সরে যাবার সাথে সাথে ক্ষয়ক্ষতির জরিপ আমরা মন্ত্রনালয়ে জানাব। পাশাপাশি তিনি ডিএই’র মাঠ কর্মীদের কৃষকদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রেখে পানি সরে যাবার সাথে সবধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের নির্দেশের কথাও জানান।
গত রবি মৌশুমে দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলায় সোয়া লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদনের পরে আউশ আবাদে মাঠে নামেন কৃষকগন। সারা দেশে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টরের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলেই প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ করেছেন এ অঞ্চলের কৃষকগন। উৎপাদন লক্ষ রয়েছে ৬ লাখ ৬ হাজার টন চাল। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০Ñ৩৫% জমির আউশ ধান কর্তন শেষ হলেও বাকি উঠতি ধানের প্রায় পুরোটাই বর্তমান দূর্যোগে পানির তলায়।
অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলে প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমন আবাদের মৌশুম শুরু হলেও প্রকৃতির রুদ্র রেশ সেখানেও থাবা বসিয়েছে। চলতি মৌশুমে দক্ষিণাঞ্চলে ৫ লাখ ১৫ হাজার ৫২২ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের মাধ্যমে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কৃষকরা মাঠে নামলেও ইতোমধ্যে রোপনকৃত ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন সহ বোনা আমনের পুরোটাই পানির তলায়। প্রয়োজনীয় আমন বীজতলা তৈরী সম্পন্ন হলেও সেখানেও অথৈ পানি। ফলে প্লাবনমূক্ত হবার পরে এসব বীজ রোপনের কতটা উপযুক্ত থাকবে তা বলতে পারছে না কেউ।
অথচ পুরো আউশ ঘরে তোলা সহ চলতি আমন মৌশুমে লক্ষ্য অর্জিত হলে দক্ষিণাঞ্চলে এক বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন দানাদার খাদ্য ফসল উৎপাদন সম্ভব হত বলে আশাবাদী ছিলেন কৃষিবীদগন। বিগত বছরগুলোতে দক্ষিণাঞ্চল খাদ্য উৎপাদনে ৭ লক্ষাধীক টন উদ্বৃত্ব এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে কৃষি মন্ত্রনালয়ে।
দুটি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পরে চলমান করোনা সংকট পাশে রেখে ঘুরে দাড়ানোর মুখেই প্রকৃতির আরেক বিরূপ প্রভাবে লন্ডভন্ড হতে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিই দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। যে কোন রাজনৈতিক ও প্রকৃতিক সংকটে কৃষি অর্থনীতিই দক্ষিণাঞ্চলের অর্থÑসামাজিক ব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকা পালন করলেও তা এখনো প্রকৃতি নির্ভর।
এবারের করোনা সংকটেও মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের অপার দান কৃষি ব্যবস্থাই লালন করছিল গোটা দক্ষিনের আর্থÑসমাজিক ব্যবস্থাকে মন্তব্য কৃষি অর্থনীতিবীদদের। কিন্তু প্রবল বর্ষনের সাথে উজানের ঢল আর ফুসে ওঠা সাগরের জোয়ারের পানি সব কিছুই যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।