দক্ষিণাঞ্চলে গরিব ও এতিমদের প্রায় ২২ কোটি টাকা লোপাট দক্ষিণাঞ্চলে গরিব ও এতিমদের প্রায় ২২ কোটি টাকা লোপাট - ajkerparibartan.com
দক্ষিণাঞ্চলে গরিব ও এতিমদের প্রায় ২২ কোটি টাকা লোপাট

3:01 pm , November 2, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ কোরবানির পশুর চামড়ার আয় বঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার এতিমখানা ও মাদ্রাসা সংযুক্ত লিল্লাহ বোর্ডিং এবং কয়েক লাখ ছিন্নমুলÑঅভাবী আর এতিমের এবার যথেষ্ট দুরাবস্থা শুরু হয়েছে। এসব এতিমদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের একাধিক চামড়া ব্যবসায়ী চক্র। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতায় হতবাক দক্ষিণাঞ্চলের এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সংশ্লিষ্ট সহ সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা।
দক্ষিনাঞ্চলের বেশীরভাগ এলাকাতেই বিগত কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে পারেননি অনেক মানুষ। এমনকি লিল্লাহ বোর্ডিং সহ এতিমখানাগুলো পর্যন্ত কোন পশুর চামড়া কিনতে সাহস করেনি ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। অনেক মাদ্রাসা ও এতিমখানা বিনামূল্যে কোরবানির চামড়া পেলেও তা বিক্রি করতে না পেরে মহাসংকটে পড়েছে। এমনকি অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান চমড়ায় লবন দেয়ার অর্থ সহ পরিবহন ব্যয়ের অর্থও তুলতে পারেনি। বেশীরভাগ কোরবাননি দাতাই অনেক অনুরোধ করে বিনামূল্যে এসব চামড়া এতিমখানায় দিলেও সেসব প্রতিষ্ঠানও তা নিয়ে নিয়ে বিপাকে পড়ে। বেশীরভাগ লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানাগুলো অনেক অনুনয় বিনয় করে ১শ টাকা দরেও একটি গরুর চামড়া আড়তে বিক্রি করতে পরেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত দিনে মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানাগুলো বিনামূল্যে বা প্রতিকী মূল্যে কোরবানির চামড়া কিনে পাইকার বা আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে অর্জিত মুনাফা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা করত। আর এখাত থেকে অর্জিত মুনাফা এতিমদের ভরন পোষনেই ব্যয় করতেন। কোরবানিদাতাগন পশুর চামড়া বা এর বিক্রিত অর্থ একাধিক এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং ছাড়াও গরীব মিসকিনদের মধ্যেই বন্টন করতেন ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী।
কিন্তু চামড়ার আড়তদারগন কারসাজি করে গত আগস্টে কোরবানির দিন মাঠ পর্যায় থেকে কোথাও নামমাত্র মূল্যে আবার কোথাও বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করার অভিযোগ ছিল এতিমখানা সহ সুবিধা বঞ্চিত মহলের। কোরবানি দাতাগন বেশীরভাগ পশুর চামড়া বিনামূল্যেই দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যার পেছনে ট্যানারী মালিকদের ভূমিকা ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রকৃত কোন তথ্য প্রশাসনের কাছে ছিলনা বলেও জানা গেছে। ফলে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেনি। সময়মত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে হয়ত এ বিপর্যয় এড়ানো যেত বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহল মহল।
বিগত ঈদ উল আযহায় দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলাতে ৪ লাখ ৩৪ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে বলে জানিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর। যা ছিল আশাতিত এবং গত বছরের চেয়ে অন্তত ১৫% বেশী। কোরবানিকৃত পশুর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ষাড়, ২৩ হাজার গরু ও বকনা এবং ১ হাজার মহিষ ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ছাগল ও খাসি সহ প্রায় ১২শ ভেড়া ও অন্যান্য পশু কোরবানি হয়েছে। প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, দক্ষিণাঞ্চলেও বছর জুড়ে যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকই হয়ে থাকে ঈদ উল আযহার সময়ে। অধিদপ্তরের মতে দেশে প্রতিবছর সোয়া দু’কোটি পশু জবাই হয়ে থাকে। এবছর তা আরো কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিগত ঈদ উল আযহার সময়ও দক্ষিণাঞ্চলে যে প্রায় ৪.৩৪ লাখ বিভিন্ন ধরনের পশু কোরবানি হয়েছে, তার চামড়ার নুন্যতম গড়মূল্য ৫শ টাকা হিসেব করলেও এ অঞ্চলের এতিমখানা, মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সহ গরিব ও দুঃস্থ মানুষ অন্তত ২২কোটি টাকা পেতে পারতেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ গরীবÑমিছকিন ও এতিমদের মুখের সে গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো সারা বছরই কোরবানির সময়ে পশুর চমড়া বা এর বিক্রিত অর্থের দানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু এবার এতিমÑগরীব আর লিল্লাহ বোর্ডিং-এর মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সে অর্থের প্রায় পুরোটাই চলে গেছে চামড়া ব্যবসায়ীদের পকেটে।
বিগত ঈদ উল আযহার দিন থেকে নানামুখি ফন্দি ফিকির করে কোরবানি দাতা এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর কাছ থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহ করে তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের বেশীরভাগ আড়তদার ট্যনারি মালিকদের কাছ থেকে গত বছরের বকেয়া এখনো আদায় করতে পারেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিগত কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে একাধিক মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালকদের তরফ থেকে, “ট্যানারী মালিক ও আড়তদারদের ‘সংঘবদ্ধ চক্রান্ত” বলে দাবী করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ‘নানা পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরী করে কোরবানির দিন কাঁচা চামড়ার বেশীরভাগই বিনামূল্যে ও কিছু পানির দরে সংগ্রহ করে মুনাফা লুটেছে সংঘবদ্ধ চক্রটি’।
দক্ষিণাঞ্চলের চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত বরিশালে। এ অঞ্চলের সবগুলো জেলা থেকে বেশীরভাগ চামড়া এখানে নিয়ে আসে মাঠ পর্যায়ের ক্রেতা ছাড়াও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এখান থেকে তা ঢাকার বড় আড়ত হয়ে ট্যানারীতে চলে যায়। লবন দেয়া এসব চামড়ার একটি অংশ কিছু ট্যানারীতেও সরাসরি চলে গেছে। আবার অনেক জেলা থেকে লবন দেয়া চামড়া সরাসরি ঢাকার আড়তে গেছে। এবার দক্ষিণাঞ্চলের কোন আড়তদারই বানিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋন পাননি বলে অভিযোগ করে পুজির সংকটের অজুহাতে তারা চামড়া না কেনার কথা জানিয়ে বিনামূল্যে বা নামমাত্র দরে কিনেছেন।
তবে কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহের পরে মাঠ পর্যায়ের ক্রেতাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া কেনার অর্থ কিভাবে যোগান হয়, তার উত্তরে আড়তদারদের দাবী, তারা ‘বাকিতে চামড়া কিনছেন’। তবে মাঠ ক্রেতাদের দাবী পুরোটাই তারা বাকিতে বিক্রি করেননি। লগ্নিকৃত পুজির টাকাটা তারা আড়তদারদের কাছ থেকেও পোয়েছেন’। এদিকে গতবছর যেসব মাদ্রাসা ও এতিমখানা স্থানীয় আড়ত সহ পাইকারদের কাছে চামড়া বিক্রি করেছিলেন, তার অর্থও এক বছর পার হলেও এখনো পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋন নিয়ে ও তহবিলের টাকা খরচ করে মাদ্রাসাগুলো ঐ চামড়া সংগ্রহ করে আড়তে দিয়েছিল। একবছর পরেও লাভ দুরের কথা, চামড়া কেনার আসল টাকাও তুলতে পারেননি একাধিক মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষও এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা থেকে কোন দান গ্রহন করতে পারেননি এসব চক্রান্তের কারনে। যা ছিল ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাদের হক।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT