মা ইলিশ শিকারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে মধ্যরাতে মা ইলিশ শিকারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে মধ্যরাতে - ajkerparibartan.com
মা ইলিশ শিকারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে মধ্যরাতে

2:59 pm , October 30, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ মূল প্রজননকে নির্বিঘœ রাখতে উপকুলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ আহরন সহ সারা দেশ ইলিশের আহরন, পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা বুধবার মধ্যরাত থেকে উঠে গেছে। তবে শুক্রবার রাতের প্রথম প্রহর থেকে জাটকা আহরনে ৭ মাসের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ইলিশ পোনা-জাটকা আহরন, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকবে। অনুর্ধ্ব ৩০ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চি সাইজের ইলিশ পোনাকে জাটকার সংজ্ঞা দিয়েছে মৎস অধিদপ্তর। ইলিশ আহরনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কারনে গত কয়েকদিন ধরেই দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলো ধীরে ধীরে কোলাহল মুখর হয়ে উঠেছে। জেলে পল্লীগুলোতেও কর্মচঞ্চলতা লক্ষ্য করা গেছে। জেলেরা নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে অনেকটা অখন্ড অবসর কাটালেও গত দুÑতিন দিন ধরে জাল ও নৌকা-ট্রলার মেরামত সহ মাছ ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গত সপ্তাহের দূর্যোগ কাটিয়ে আবহাওয়া অনুকুলে ফিরে আসায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই হাজার হাজার জেলে নৌকা ও ট্রলার দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীন নদ-নদী ও সাগর উপকূলীয় এলাকায় জাল ফেলবে বলে আশা করছেন মৎসজীবীগন। মোকামের মহাজনরা মাছ কেনার জন্য জেলেদের আগাম অর্থ বা দাদনও দিয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যেই অভ্যন্তরীন নদ-নদীর ইলিশ বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে আসবে বলে আশা করছেন মৎস্যজীবীরা।
আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমাকে সামনে রেখে গত ৯ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ৩০ অক্টোবর মধ্যরাত পর্যন্ত ইলিশ আহরনে নিষেধাজ্ঞা বলবতকালীন সময়ে দক্ষিণাঞ্চল সহ সারা দেশে আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তর ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করলেও এবারই নিষেধাজ্ঞা অমান্যের প্রবনতা ছিল সবচেয়ে বেশী। এমনকি বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার ছাড়াও আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত অবৈধভাবে ইলিশ আহরন করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে গত ১০অক্টোবর থেকে সারা দেশে ইলিশ আহরন বন্ধ রাখতে প্রায় ১৩ হাজার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে প্রশাসন সহ আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায়। এসময় প্রায় ৩ হাজার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে সাড়ে ৫ হাজার জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে প্রায় ৯৭ লাখ টাকা। প্রায় সোয়া ৭ লাখ মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল আটক করা হয় এ ২২ দিনে। যার বাজার মূল্য ১শ কোটি টাকার ওপরে। এছাড়াও অভিযানকালে শতাধিক টন ইলিশ আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। এসব অভিযানকালে বেশ কিছু জেলে নৌকাও আটক করে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এবারের অভিযান পরিচালনা সহ জেল-জরিমানা এবং মাছ, জাল ও জেলে নৌকা আটকের সিংহভাগই হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায়। সারা দেশে উৎপাদিত ইলিশের ৬০%ই উৎপাদন ও আহরন হয় দক্ষিনাঞ্চলের ৬টি জেলায়।
নিষিদ্ধকালীন ২২ দিনে এবার ইলিশ আহরন বিরত জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তা হিসেবে সরকার ৮ হাজার ১৬৬ টন চাল প্রদান করেছে। কর্মসূচীর আওতায় সারা দেশে ৪ লাখ ৮ হাজার ৩২৯ জেলেকে ২০ কেজি করে চাল প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ২ লাখ ২৭ হাজার ৩৪৩টি জেলে পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার ৫৪৬ টন চাল বিতরন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’এর আওতায় ২০০৫ সালেই সর্বপ্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয় ১০ দিন। ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিনে ও ২০১৬ সালে থেকে তা ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য খাতে এমাছের অবদান প্রায় ১২-১৩%। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত ও আহরিত হচ্ছে। গত অর্থ বছরে যে প্রায় সোয়া ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে তার ৬০%ই পাওয়া গেছে বরিশালে বিভাগের অভ্যন্তরীন ও উপকূলীয় জলাশয় থেকে। ১৯৮৭-৮৮ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন ও সহনীয় আহরন ছিল ১.৮৪ লাখ টনের মত। যা ২০০৬-০৭ সালে ২.৮০ লাখ টনে উন্নীত হয়। ২০১৭-১৮ সালে এ মাছের উৎপাদন ৫.১৭ লাখ টনে উন্নীত হবার পরে গত অর্থবছর তা সোয়া ৫ লাখ টনে পৌছেছে। এরমধ্যে শুধু বরিশাল বিভাগেই ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩.৩০ লাখ টন। মৎস অধিদপ্তরের মতে গত এক দশকে বরিশাল বিভাগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১১৫%-এরও বেশী।
গত বছর আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে পরের ২২দিন ইলিশ আহরন নিষদ্ধকালীন সময়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআই। ইনস্টিটিউট-এর মতে প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ২০১৭ সালে ৭৩% থেকে ’১৮ সালে ৯৩%-এ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি প্রজনন সাফল্যের হারও ৮০%-এ উন্নীত হয়েছে। গত বছর ইলিশ আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশের উপকুলভাগে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়। যার ৫০% ডিম পরিস্ফুটিত হয়ে ১০% বেঁচে থাকলেও দেশে গত বছর শুধু মূল প্রজনন মৌসুমে ৩ হাজার কোটি জাটকা মূল ইলিশ পরিবারে যূক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএফআরআই-এর বিশেষজ্ঞগন।
এমনকি গতবছর মূল প্রজনকালীন সময়ে প্রজনন ক্ষেত্রসমুহে নমুনা পরীক্ষা করে ৮৩% ইলিশ রেনু পোনা পাওয়া যায়। এ সময়ে ইলিশের মূল প্রজনন ক্ষেত্রসমুহে অন্যান্য মাছের রেনু পোনাও পাওয়া যায় ১৭%। ফলে ইলিশ আহরন নিষদ্ধকালীন ২২ দিনে উপকুলে অন্যান্য মাছেরও নিরাপদ প্রজনন স¤পন্ন হচ্ছে। যা দেশে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি সহ চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয় তা এ মাছের নতুন প্রজন্ম গঠন করে। আর আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে পড়ের এ সময়ে দেশের চট্টগ্রাম উপক’লের মায়ানী পয়েন্টÑমীরসরাই, ভোলার পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্টÑতজুমদ্দিন, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পয়েন্ট এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট-এর ধলচর দ্বীপ, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ ও কালিরচর দ্বীপ এলাকায় মা ইলিশের অত্যাধীক প্রচুর্য লক্ষ করা যায়। ঐসব এলকার ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে আশি^নের পূর্ণিমার আগে পরের ২২দিন সবধরনের মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ ছিল।
ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্রকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষে গত ২৬জুন থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজর্ভ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে যে পরিমান জাটকা আহরন করা হয়, তার এক-দশমাংশ রক্ষা করা গেলেও বছরে আরো অন্তত ১ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেত।
অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ তার জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। একটি পরিপক্ক ইলিশ প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে পারে। উপকুলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মূক্তভাবে ভাসমান ডিম থেকে ফুটে বের হবার পরে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে বিচরন করে। এরা খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনের লক্ষ্যে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্কতা অর্জন করে প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। এর পরে তারা আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে আসে।
সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা খাদ্য গ্রহন করে বেড়ে ওঠে সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র হিসেবে চিহিৃত করায় অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হয়েছে। চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে ভোলার চর ইলিশা হয়ে চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর ১শ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, শরিয়তপুরের নরিয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ন পদ্মার ১২০ কিলোমিটার এবং বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জের লতা, নয়া ভাঙ্গনী আর ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলের ৮২ কিলোমিটার এলাকায় নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অভয়াশ্রম ঘোষনা করে ইলিশ আহরন নিষিদ্ধ করায় এ মাছের উৎপাদন আশাব্যাঞ্জকভাবে বাড়ছে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT