3:03 pm , September 11, 2019
সাঈদ পান্থ ॥ এখনও পর্যটনের জন্য প্রস্তুত নয় লাল শাপলার স্বর্গ উজিরপুর উপজেলার সাতলা। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই লাল শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলেও এখনও পর্যটকদের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠেনি। এখানে গড়ে উঠেনি কোন হোটেল-মোটেল বা রেষ্ট হাউজ। এমনকি নেই কোন ওয়াস রুম বা টয়লেটের ব্যবস্থা। কোন পর্যটককে বাথরুম ব্যবহার করতে হলে পার্শ্ববর্তি বাড়িতে যেতে হয়। অপরদিকে সরু সড়ক ও সংস্কারের অভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেহাল। সর্বোপরি পর্যটকদের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠেনি এই শাপলার রাজ্য। তবে প্রশাসনের দাবী সাতলাকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। যার কারনে ইতোমধ্যে পর্যটন কর্পোরেশনেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, নগরী থেকে থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুরের সাতলা ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম। গ্রামের নামেই বিলের নাম সাতলা বিল। লাল আর সবুজের মাখামাখি দূর থেকেই চোখ পড়বে পর্যটকদের। কাছে গেলে ধীরে ধীরে সবুজের পটভূমিতে লালের অস্তিত্ব আরো গাঢ় হয়ে ধরা দেবে। চোখ জুড়িয়ে দেবে জাতীয় ফুল শাপলার বাহারি সৌন্দর্য। আগাছা আর লতাগুল্মে ভরা বিলের পানিতে ফুটে আছে হাজার হাজার লাল শাপলা। সূর্যের সোনালি আভা শাপলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বিলের সৌন্দর্য। নৌকা দিয়ে বিলের ভেতর ঢুকলে মনে হবে বাতাসের তালে তালে এপাশ-ওপাশ দুলতে দুলতে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে শাপলারা। সে হাসিতে বিলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আনন্দধারা। শাপলার রাজত্বের কারণে এখন শাপলা বিল নামেই বেশি পরিচিত সাতলা। ইতিমধ্যে বরিশালের গন্ডি ছাড়িয়ে বিলের কথা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে শহরে ইট-পাথরে বন্দি জীবন কাটানো মানুষ প্রশান্তির আশায় ছুটে আসে এ বিলে। শীত মৌসুমে পর্যটকের ভিড় বাড়ে। তবে আগষ্ট থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত চলে এই শাপলার রাজত্ব্য। পর্যটকদের প্রশান্তি বিলানো ছাড়াও এই বিল ও তার শাপলা স্থানীয়দের অন্নেরও জোগান দেয়।
সাতলার নয়াকান্দি বিল (পশ্চিম কালবিলা) ঘুরে দেখা যায়, আগাছা ঠেলে অনেকেই নৌকা নিয়ে বিলের গহিনে যাচ্ছে। বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছে নৌকায়। কেউ বা ব্যস্ত মাছ ধরায়। বিল থেকে শাপলা তুলে অনেকে তা বিক্রি করে স্থানীয় বাজারে। মাছ বিক্রি করেও সংসার চালায় অনেকে। আবার নতুন করে পেশা তৈরি করেছেন এখানকার অনেকেই। বিলে নৌকা চালিয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে পরিশ্রমি নিচ্ছেন। প্রায় ৮ বছর ধরে এ বিল নিয়ে কাজ করছেন সেলিম খান। পেশায় এক জন কৃষক হলেও তিনি এখন তার পেশা পরিবর্তন করে বিলে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সঙ্গে করে পর্যটক নিয়ে বিলে বিলে ঘুরছেন তিনি। তিনি বলেন, উজিরপুরের সাতলা এবং পাশের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বিছিয়ে আছে শাপলার বিল। বিলের সঠিক আয়তন জানা নেই কারো।
তবে স্থানীয়দের মতে, প্রায় ২০০ একর জমির ওপর প্রাকৃতিকভাবে বিলটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের অনেকে জীবিকার জন্য বছরের একটা বড় সময় বিলের মাছ ও শাপলার ওপর নির্ভরশীল। বিলে ঠিক কত আগে থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে, সে তথ্যও দিতে পারেনি স্থানীয়রা। নগরী থেকে উজিরপুরের সাতলার নয়াকান্দি বিলে ঘুড়তে যাওয়া মেরিন জাহান জানান, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তার ভিতরে সাতলা একটি অন্যতম স্থান। এই স্থানটিতে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও স্থানীয়দের উদ্যোগ থাকে তবে তা করা সম্ভব।’
অপর এক পর্যটক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমি আমার পরিবার নিয়ে এই শাপলার বিলে এসেছি। প্রায় ২ ঘন্টা সফর করে সবাই ক্লান্ত। কিন্তু শাপলা সবার মন ও ক্লান্তি দুর করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। কারণ এখানে কোন খাবার হোটেল নেই। নেই বাথরুমে ব্যবস্থা। বিলের পাশে এই বাড়িতে গিয়ে বাথরুম করতে হয়েছে।’ পর্যটক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এই শাপলার বিল হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু এ জন্য যেসব সুযোগ সুবিধা দরকার তা গড়ে তুলতে হবে। নতুবা যারা একবার আসবে তারা আর আসবে না।’ সাতলার সাতলার নয়াকান্দি বিল এলাকার বাসিন্দা মো: কলিমুল্লাহ বলেন, আমরার জন্মের পর থেকেই বিলে এভাবে শাপলা ফুটতে দেখেছি। এ বিলে তিন ধরনের শাপলা জন্মে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙের। তবে লাল শাপলাই বেশি। এর পর সাদা। সাধারণত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিলে শাপলা থাকে।
সাতলা গ্রামের স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক মিজানুর রহমান বলেন, ‘দিনে দিনে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। কিন্তু সরকারি ভাবে তেমন কোন উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে না। এখনো অনেক সড়ক ভেঙে পড়ে আছে। বিশেষ করে ষোলক ইউনিয়নের ধামুরা সড়ক। একই ভাবে সংস্কারের অভাব দেখা দিয়েছে সাতলা-বাগদা সড়কে। এছাড়া অধিকাংশ স্থানের সড়কের প্রস্থ মাত্র ১২ ফুট। এটিকে পর্যটন কেন্দ্র করতে হলে ১৮ থেকে ২০ ফুট সরকার নির্মান করা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘এলাকার অনেক মানুষই এখন শাপলার উপর জীবিকা নির্বাহ করছেন। সাদা শাপলা রান্না করে খাওয়া অনেক পুষ্ঠিকর। এছাড়া শাপলায় অনেক আয়রন থাকে। আগে বিলে প্রচুর শাপলা জন্মালেও এখন পলি পড়ে বিল ভরাট হতে থাকায় পানি কমে যাচ্ছে, ফলে আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে শাপলার উৎপাদন। বিলের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কারণেও শাপলা কমে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
সাতলার ইউনিয়র পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক আজাদ বলেছেন, সাতলার বুক জুড়ে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সব শ্রেনীর মানুষ ভিড় করছে এখানে। এখন এটিকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষনার অপেক্ষায় আছি আমরা। এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘এই শাপলার রাজ্যকে নিয়ে প্রশাসনের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। যার কারণে সাতলাকে পর্যটন কেন্দ্র করার বিষয়ে পর্যটন কর্পোরেশনকে লেখা হয়েছে। যেখানে পানি, বাথরুম এর ব্যবস্থা থাকবে এ জন্য স্থানীয় ভাবে রেষ্ট হাউজ করার চেষ্টা চলছে। পর্যটকরা যেন ঘুরে ফ্রেস হতে পারে এ বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।