2:29 pm , September 1, 2019
সাঈদ পান্থ ॥ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু জ্বরের প্রার্দুভাব থেকে রক্ষা করতে মাঠে নেমেছে বিশেষজ্ঞ টিম। ইতোমধ্যে তারা নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। অনুসন্ধানে নামা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের দিক থেকে দেশের মধ্যে বরিশাল বিভাগ ৩য় অবস্থানে রয়েছে। তাই সরকার এই বিভাগকে বিশেষ নজরদারীর আওতায় রেখে ডেঙ্গুর নমুনা সংগ্রহে মাঠে নেমেছে তারা। নগরীর ৩০০ পরিবারের তথ্য-উপাত্ত ও নমুনা সংগ্রহ করতে ১৯ জনের এই বিশেষজ্ঞ টিম গত ২১ আগষ্ট থেকে মাঠে কাজ শুরু করে দিয়েছে। জানা গেছে, ঢাকা থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য জেলার তুলনায় বরিশালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। শুধু তাই নয়, সারা দেশের মধ্যে বরিশাল বিভাগকে ৩য় বলা হয়েছে। এসব কারণ অনুসন্ধানের জন্য এখানে জরিপ চালানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জেলা উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গুর উৎস স্থানীয় এডিস মশা কিনা, তা চিহ্নিত করা না হলে এর প্রকোপ কমবে না। তারা জরিপ করা জরুরী। তারা বলছেন ঢাকার বাইরে জেলাগুলোর মধ্যে বরিশালে যেহেতু ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। সেজন্য এখানে জরিপ চালানো হচ্ছে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশালের সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন, ‘এডিস মশার সন্ধান বরিশালেও পাওয়া গেছে। যার কারণে শুধু মাত্র ঢাকা থেকে আসা রোগীই নয়, বরিশালে বসেই মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর বরিশালে সারা দেশের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশী। যার কারণে বরিশালে বিশেষজ্ঞ টিম ডেঙ্গুর তথ্য-উপাত্ত ও নমুনা সংগ্রহ করছেন।’ তিনি বলেন, ‘এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা কোনদিন বাড়ছে, কোনদিন কমছে। তবে প্রতিদিন গড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ১শ’র বেশি থাকছে শুধু মাত্র বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। আগের বছরগুলো রেকর্ডে অগাষ্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকে।’
জানা গেছে, এডিস, বিশেষ করে এডিস ইজিপটাই মশার কামড়ে ভাইরাসটি মানব শরীরে প্রবেশ করে। প্রতি বছর আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে কয়েক শ’ হাজার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রিপোর্ট পাওয়া যায়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলোতে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর কথা জানা যায়।
এটি ১৯৮১ সালে কিউবায় মহামারীর আকারে দেখা দেয় এবং ১৯৮৯ সালে দেখা দেয় ভেনিজুয়েলায়। বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট মতে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৬ জন রোগীর মধ্যে মারা গেছে ৯ হাজার ৭৭৪ জন। পর্যাক্রমে মশাগুলোর এক দেশ থেকে অন্য দেশে অনুপ্রবেশ করে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে নতুন রোগ চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন। এ বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে কোনো অন্য বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আরও প্রাণঘাতী হয়েছে।
যার কারণে গত ২১ আগষ্ট থেকে আইইডিসিআরের ১৯ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল বরিশালে কাজ শুরু করেছে। দলটির সদস্যরা জানান, রোগতত্ত্ব ও কীটতত্ত্ব বিভাগের দুটি দলে ১৯ জন সদস্য বরিশালের প্রতিটি ওয়ার্ডে কাজ শুরু করেন। সদস্যরা রোগতত্ত্বের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ৬টি দলে এবং কীটতত্ত্বের সদস্যরা ৫ টি দলে বিভক্ত হয়ে এই নগরে কাজ করছেন। রোগতত্ত্বের দলগুলো নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে খানা জরিপ, জনসংখ্যার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগী আছে কি না, তা যাচাই এবং চলতি বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের রোগের ইতিহাস এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছে। তারা নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ৩০০ পরিবারের তথ্য-উপাত্ত ও নমুনা সংগ্রহ করে। অন্যদিকে কীটতত্ত্বের ৬টি দল নগরীর ১২টি ওয়ার্ড বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, হাসপাতালগুলো থেকে মশার লার্ভার নমুনা সংগ্রহ করে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে। এরপর তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভাগের ৬ জেলায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে পিরোজপুর জেলায়। বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৩৮১ জন। রোববার পর্যন্ত এই হাসপাতালে ৭ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল নগর ভবন সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে বরিশাল নগরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য ১৫০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়মিত কাজ করছিলেন। মধ্য জুলাই থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৮টার পর প্রতিটি ওয়ার্ডে হ্যান্ড স্প্রে দিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের প্রধান ডাঃ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে গত ডিসেম্বর থেকে তাঁদের নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। তবে ডেঙ্গু প্রবণতার পর এই কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে।
আইইডিসিআর’র বিশেষজ্ঞ দলটির প্রধান গবেষক ও রোগতত্ত্ববিদ ওমর কাইউম বলেন, বরিশালে ডেঙ্গুতে আক্রন্তর সংখ্যা বেশী পাওয়া গেছে। কেন বেশী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে? এর পেছনে কি হতে পারে, সেটা চিহৃত হতে আমরা মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু জানা যাবে। তিনি বলেন, ‘মশার লার্ভা থেকে মশার প্রজাতি শনাক্ত করা হচ্ছে। এটি সময় স্বাপেক্ষ বিষয়। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা: বাকির হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু আসলে বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে। এরসাথে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কি নেয়া হচ্ছে, তার ওপর রোগীর কমা বাড়াটা নির্ভর করে। কিন্তু এবার পুরো অগাষ্ট মাস জুড়েই দেখতে পেয়েছি, রোগী মোটামোটি স্থিতিশীল।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এটা স্থিতি অবস্থায় আছে। আর কিছুদিন হয়তো আরেকটু এরকম থেকে আস্তে আস্তে এটা নামতে শুরু করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এবার ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগ বেশি হওয়ায় মানুষও অনেক সচেতন হয়েছে। যার কারণে তারা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক হয়েছে।
এব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পিরোজপুর ও পটুয়াখালীতে রোগীর সংখ্যা বেশী। যদিও এর আগে বরিশাল জেলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশী ছিল। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগতে পারে। এই ডেঙ্গু অনুসন্ধানের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দল মাঠে কাজ করছে। খুব শীঘ্রই এর অবস্থান সর্ম্পকে জানা যাবে।