3:06 pm , August 25, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ মূল প্রজনন মৌসুমকে সামনে রেখে অসময়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় ইলিশের বিচরন ও আহরন এর বংশ বিস্তারকে ব্যাহত করতে পারে বলে শংকিত মৎস্য বিভাগ। চলতি মৌশুমের মত গতবছরও ভরা বর্ষায় বৃষ্টির অভাবে সাগর ও উপকূলীয় নদ-নদীতে তাপমাত্রার আধিক্য ইলিশের বিচরনকে ব্যাহত করে। ফলে আশ্বিনের পূর্ণিমার মূল প্রজননকালের আগেভাগেই ঝাকে ঝাকে ইলিশ সাগর থেকে উপকূল হয়ে অভ্যন্তরের নদ-নদীতে উঠে এসেছিল। গত সপ্তাহখানেক ধরে গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলীয় এলাকা সহ উপকূল সংলগ্ন অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে ইলিশের আধিক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। অসময়ে ইলিশের এ আধিক্য জেলেদের মুখে সাময়িক হাসি ফুটালেও তা সুদুর প্রসারি বিপত্তি সৃষ্টি করতে পাড়ে বলে মনে করছে মৎস অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল। বরিশাল, পিরোজপুরের পাড়েরহাট, পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং আলীপুরÑমহিপুর ও গলাচিপা, বরগুনার পাথরঘাটা ছাড়াও ভোলার চরফ্যাশনের মোকামগুলোও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে মূল প্রজনন মৌসুমের আগের এ ইলিশে। বাজারের ইলিশের আমদানী বাড়ায় দামও কিছুটা পড়তির দিকে। ইলিশের হাত ধরে অন্য মাছের দামও কিছুটা সহনীয় পর্যায়ের কাছে আসছে। কিন্তু আসন্ন আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার সময়টিই ইলিশের মূল প্রজনন মৌসুম। আশ্বিনের প্রথম উদিত চাঁদের পূর্ণিমার আগের ৪দিন ও পরের ১৭দিন সহ মোট ২২দিন ইলিশের মূল প্রজননকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মৎস বিজ্ঞানীগন। এসময়ে উপকূলের ৪টি এলাকার ৭হাজার বর্গ কিলোমটার প্রজনন এলাকায় সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ সারা দেশে ইলিশ আহরন, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকবে। এমনকি ইলিশ আহরন নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে বেকার জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তাও প্রদান করছে সরকার। কিন্তু মূল প্রজনন মৌশুমের আগের এসময়কালে সাগর থেকে ব্যাপকহারে যে ইলিশ উঠে আসছে তার ৯০ভাগের পেটেই ডিম রয়েছে। আর একমাস পরেই আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে থেকে পরের দিন পনের যাবত এসব মা ইলিশ উপকূলীয় এলাকায় ডিম ছাড়ার কথা রয়েছে। অথচ অসময়ে মা ইলিশের দল সাগর থেকে উপকূল হয়ে দক্ষিণের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে উঠে আসায় উদ্বিগ্ন মৎস বিজ্ঞানীগন।
মৎস অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোঃ অলিয়র রহমান জানান, এসময়ে অধিকহারে ইলিশ সাগর থেকে উঠে আসা মোটেই ভাল লক্ষন নয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষনার ওপরও জোর দেন তিনি। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক জানান, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে গতবছর এবং এবারও বর্ষা মৌমুমে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমান স্বাভাবিকের কম। পাশাপাশি তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের ১-৩ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশী। ফলে উপকূলীয় এলাকা সহ উপকূল অভ্যন্তরের নদÑনদী সমুহের পানি যথেষ্ঠ উত্তপ্ত। একদিকে বৃষ্টির অভাব, অপরদিকে তাপমাত্রার আধিক্যের সাথে নদ-নদী ও সাগর উপকূলের পনির উষ্ণতাও বেশী থাকায় ভরা বর্ষায় সাগর থেকে এবার সময়মত ইলিশ উজান ঠেলে উপকূল অভ্যন্তরে আসেনি। মৎস বিজ্ঞানীদের মতে একটি পূর্ণ বয়স্ক ইলিশ শ্রোতের বিপরিতে প্রতিদিন ৭২ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে সক্ষম। ইলিশ সারা বছর কমবেশী ডিম ছাড়লেও আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পড়েই গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলের সাগর মোহনার ৪টি এলাকার প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে ডিম ছেড়ে আবার পুরনো আবাসে ফিরে যায়। কিন্তু এবার ভাদ্রের শুরু থেকে উপকূল হয়ে সাগর মোহনার নদ-নদীতে ইলিশের উপস্থিতি মৎস বিজ্ঞানী সহ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলদের দুঃশ্চিন্তা কিছুটা বৃদ্ধি করছে। আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য খাতে এ মাছের অবদান প্রায় ১২-১৩%। আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে পড়ে ২০১৫ সালের ইলিশ আহরন নিষিদ্ধকালীন সময় ১৫ দিনের স্থলে ২০১৭ সালে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। ফলে এসময়ে ইলিশের নিষিক্ত ডিমের পরিমান ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬৫ কেজি থেকে ৩৭% বেশী, অর্থাৎ ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৫ কেজিতে উন্নীত হয়। এমনকি ইলিশ পোনা জাটকার উৎপাদনও ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২ হাজার ২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সারা বিশ্বে যেখানে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বছর তা গড়ে ৫-১০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দেড় দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত ও আহরিত হচ্ছে। গত বছর দেশে যে প্রায় সোয়া ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে, তার ৬০%ই পাওয়া গেছে বরিশালে বিভাগের অভ্যন্তরীন ও উপকূলীয় জলাশয় থেকে। গত দুই দশকে বরিশাল বিভাগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০%-এরও বেশী।