2:54 pm , August 18, 2019
খান রুবেল ॥ নগরবাসির গলার কাটা হয়ে আছে সড়কে চলাচলরত হলুদ অটো রিক্সা (ইজি বাইক)। বেপরোয়া এই অবৈধ ইজি বাইকের কারণে সৃষ্ট যান-জট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। এমনকি যান-জটে বিব্রত খোদ সিটি মেয়রও জানিয়ে দিয়েছেন এর দায়ভার না নেয়ার কথা। ঠিক সেই মুহুর্তে নগরীর ১৪টি পয়েন্ট থেকে বিট দিয়ে চলছে টোকেন বিহীন অবৈধ অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছে শ্রমিক নেতা নামধারী ১৩ ব্যক্তি। তাদের পেছনে থেকে বিট বানিজ্যে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে খোদ ট্রাফিক বিভাগের টিআই ও এক কনস্টেবলের বিরুদ্ধে। তবে ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগ বার বারই এড়িয়ে যাচ্ছেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এমনকি নেয়াও হচ্ছে না অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ। ফলে ট্রাফিক বিভাগের নিরবতাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছেন অভিযুক্তরা। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানাগেছে, দ্বিতীয় পরিষদ এবং তৃতীয় পরিষদের মেয়রদের সময়ে ২ হাজার ৬১০টি অটোরিক্সার লাইসেন্স (টোকেন) প্রদান করে সিটি কর্পোরেশনের যানবাহন লাইসেন্স শাখা। বর্তমানে টোকেনধারী ও টোকেন বিহীন অটোরিক্সার সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি বলে দাবী ট্রাফিক বিভাগের। অবৈধ অটোরিক্সার মধ্যে কিছু সংখ্যক অটো আসছে নগরীর বাইরে থেকে। নগর ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, ইতিপূর্বে দেশে চলাচলরত সকল অটোরিক্সা (ইজি বাইক) অবৈধ ঘোষনা করে বন্ধের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। নির্দেশ বাস্তবায়নে প্রাথমিক পর্যায়ে বরিশাল সিটি’র প্রাণ কেন্দ্র সদর রোড সহ কয়েকটি সড়কে ইজি বাইক চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কিন্তু বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের চতুর্থ পরিষদের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অপবাদ থেকে মুক্তি পেতে শহর কেন্দ্রীক পুনরায় অটোরিক্সা চলাচলের ব্যবস্থা করে দেন। পাশাপাশি শহর কেন্দ্রীয় দ্রুত গতির থ্রি-হুইলার মাহেন্দ্র চলাচল বন্ধ করেন তিনি। এতে নগরবাসির দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে ধারণা ছিলো সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা। নগরীর মুল সড়কে এত সংখ্যক অটোরিক্সা ঢুকে পড়েছে যা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। তাদের দাবী মতে শহরের কাকলির মোড় তিন রাস্তার মোড় থেকে প্রতি মিনিটে ২০ থেকে ৩০টি অটোরিক্সা আসা যাওয়া করছে। এর ফলে গোটা সদর রোড, ফজলুল হক এভিনিউ, গির্জা মহল্লা ও জেল খানার মোড় পর্যন্ত যানজট এখন নিত্য দিনের ভোগান্তিতে পরিনত হয়েছে। এদিকে সিটি কর্পোরেশনের যানবাহন লাইসেন্স শাখা থেকে জানানো হয়েছে, অটোরিক্সার কারণে সৃষ্ট যানজট নিয়ে বিব্রত খোদ সিটি মেয়র। যে কারনে তার নির্দেশেই গত অর্থ বছর থেকেই অটোরিক্সার লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখা হয়েছে। তার মধ্যে নগরীর বাইপাস সড়ক গুলোতে অবৈধ ভাবে চলাচলকারী টোকেন বিহীন অটোরিক্সা নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে নগর কর্তৃপক্ষকে। তথ্যানুসন্ধানে জানাগেছে, নগরীর মুল শহরের শেষ ভাগে ১৪টি পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে চলাচল করছে টোকেন বিহীন সহ¯্রাধিক অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছেন শ্রমিক নামধারী ১৩ জন ব্যক্তি। এরা প্রতিটি অটোরিক্সায় মাসওয়ারী বিশেষ টোকেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাসের শুরুতে স্থান ভেদে টোকেন বাবদ দুই থেকে ১২শ টাকা করে আদায় করছেন শ্রমিক নামধারীরা। অটোরিক্সা মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, নগরীর বেলতলা খেয়াঘাট থেকে লঞ্চ রুটে টোকেন বিহীন পর্যন্ত অন্তত ১০০ অবৈধ অটোরিক্সা চলছে। যা নিয়ন্ত্রণ করছে পলাশপুরের আব্দুর রব ওরফে বিট রব নামের কথিত শ্রমিক নেতা। আগস্ট মাসে অবৈধ এসব অটোরিক্সা চলাচলের জন্য প্রতিটি অটোরিক্সায় ২৫০ টাকা বিটে দেয়া হয়েছে একটি করে কাঠের তৈরী টোকেন। এস-আর-কে-এস” সংগঠনের নামে দেয়া ওই টোকেনে লেখা রয়েছে “৩০ আগস্ট ও ০১৭৭২-৪৮৮৮১০ মোবাইল নম্বর লেখা রয়েছে। টোকেনটি হয় গাড়ির মধ্যে, নিজেদের পকেটে বা চাবির রিং হিসেবে ঝুলিয়ে রাখছে। ট্রাফিক পুলিশকে যারা ওই রিং দেখাতে পারবে তারা আইনী জটিলতা থেকে রেহাই পাবে। কাঠের টোকেনের পূর্বে বিশেষ টোকেন হিসেবে দেয়া হয় সৈয়দ রাইয়ান কল্যাণ সংগঠণ নামের ভিজিটিং কার্ড। এতেও ওই একই মোবাইল নম্বর উল্লেখ ছিলো। অপরদিকে নগরীর তালতলী থেকে জেলখানার মোড় পর্যন্ত চলাচল করছে ৩৬টি টোকেন বিহীন অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছেন জেল পুলিশের পুত্র রিফাত। ওই অবৈধ অটোরিক্সাতেও একইভাবে বিশেষ টোকেন ব্যবহার করা হচ্ছে। কাউনিয়া মরকখোলার পুল থেকে কাগাশুরা রুটে চলাচল করছে ৭৪টি টোকেন বিহীন অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছে ফরদাহ ওরফে মুরগী ফরহাদ ও হায়দার নামের দুই ব্যক্তি। এদের পেছনে থেকে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে তমাল মালাকারের বিরুদ্ধে। মড়ক খোলার পুল থেকে লাকুটিয়া সড়কে চলছে ১১০টি টোকেন বিহীন অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় মোখলেছুর রহমান, তারেক ও শাহজাহান নামের কথিত নেতা। কাশিপুর বাজার থেকে বারৈজ্যার হাট-রায়াপুর রুটে চলছে ৬৫টি অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছে রিপন নামের ব্যক্তি। কাশিপুর চৌমাথা থেকে রায়পাশা পপুলার স্কুল ও বারৈজ্যার হাট রুটে চলাচল করছে আরো ২৫টি অটো। যা নিয়ন্ত্রণ করছে রিপন নামের একই ব্যক্তি। জিয়া সড়ক থেকে লোহার পুল রুটে চলাচল করছে ৩০টি অটোরিক্সা। যা নিয়ন্ত্রণ করছে আফজাল মজুমদার ও করিম নামক দুই ব্যক্তি। হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা থেকে টিয়াখালী পর্যন্ত চলছে আরো ৬৫টি অটো। এগুলোর নিয়ন্ত্রণেও রয়েছেন ওই ব্যক্তি। ধানগবেষনা থেকে সাবেক খেয়াঘাট, সাগরদী বাজার থেকে কারিকর ব্রিড়ি ব্রাঞ্চ হয়ে টিয়াখালী পুল পর্যন্ত ৬৫টি, বাস টার্মিনালে ট্রাফিক বক্স সংলগ্ন গোল চত্ত্বর থেকে সাবেক দপদপিয়া ফেরীঘাট পর্যন্ত ৫০টি, রূপাতলীর একই স্থান হতে কালিজিরা বাজার পর্যন্ত ৫০টি ও কালিজিরা বাজার থেকে টিয়াখালী পর্যন্ত চলছে আরো ৬০টি টোকেন বিহীন অবৈধ অটোরিক্সা। এর এগুলো সব নিয়ন্ত্রণ করছে অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও কেডিসি’র বাসিন্দা লেদু সিকদার, শ্রমিক নেতা আলমগীর ও রূপাতলী এলাকার জামালগাজী, সিএনজি চালক লোকমান, অটো চালক হিরণ ও কালিজিরার লিটন। কয়েকজন শ্রমিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারা রুট নিয়ন্ত্রণ করছেন তারাই মাসের শুরুতে বিশেষ টোকেন দিয়ে ট্রাফিক বিভাগ ও সাংবাদিকদের নামে মাসহারা আদায় করছে। তবে এ টাকা শেষ পর্যন্ত ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে পৌছায় কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত নন শ্রমিকরা। সূত্র আরো জানায়, টোকেন বানিজ্যের ভাগ পাচ্ছেন নগর ট্রাফিক বিভাগের দুই টিআই। তাদের মধ্যে একজন উত্তর জোন (সাগরদী পুলের উত্তর দিক) এবং অপরজন দক্ষিণ জোনে (সাগরদী পুল থেকে দক্ষিণ প্রান্ত) চলাচলকারী অটোরিক্সার বিট পাচ্ছেন। তাদের হয়ে বিট আদায় করছেন ট্রাফিক কনস্টেবল শাহাজ্জেল ও জেল পুলিশের ছেলে রিফাত। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, মাস কয়েক পূর্বে অটোরিক্সা মালিক সমিতির নাম ভাঙিয়ে একই ভাবে বিট বানিজ্য করছিলেন সংগঠনটির সভাপতি নিজাম উদ্দিন নিজাম ও সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদ আলম। পরে তাদেরকে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছিলেন বর্তমান মেয়র। এর ফলে কিছুদিন বিট বানিজ্য বন্ধ ছিলো। পরবর্তী সময়ে নিজাম ও মোর্শেদদের মত করেই পুনরায় বিট বানিজ্য শুরু একটি মহল। সম্প্রতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো আমি অটোরিক্সা বন্ধ করে টাকা খেয়ে মাহেন্দ্র চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছি। যে কারনে আমি মেয়র এর দায়িত্ব গ্রহনের পরে শহরে মাহেন্দ্র বন্ধ করে অটোরিক্সা চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু অটোরিক্সা নিয়ে বর্তমানে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে বা যা ঘটছে তার দায়ভার আমি নেবনা। এটি ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব। তারা না পারলে আমাদের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা আমাদের মত করে ব্যবস্থা নিব। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খায়রুল আলম এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে সম্প্রতি ট্রাফিক কার্যালয়ে এক আলোচনায় ডিসি ট্রাফিক বলেন, ইতিপূর্বে পত্রিকায় ট্রাফিক পুলিশের নাম ভাঙিয়ে বিট বানিজ্যের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। পরে বিষয়টি তদন্ত করে অভিযোগের প্রমান পাওয়া যায়নি। ধানগবেষনা রোডের বাসিন্দা ডালিম ও তার স্বামী কবিরকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ হয় তাদের ট্রাফিক কার্যালয়ে ডেকে সাংবাদিকের সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু তারা ট্রাফিক পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেনি। তখন তিনি বলেন, আমার জানামতে ট্রাফিক বিভাগের কেউ বিট বানিজ্যের সাথে জড়িত নয়। তার পরেও জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমান পেলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এ ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।